Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the all-in-one-wp-security-and-firewall domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home2/nababani/public_html/wp-includes/functions.php on line 6114
৭ ই মার্চ রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তোমরা আমার ভাই।
ঢাকা ০৫:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৭ ই মার্চ রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তোমরা আমার ভাই।

  • মোঃ আরিফ হোসেন
  • আপডেট সময় ০১:১২:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ মার্চ ২০২২
  • ৬২৮ বার পড়া হয়েছে

ফাইল ছবি

১৯৭১ সাল ৭ই মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন বাঙালি জাতি পেয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন বাণী,পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাঙালির মনের ইচ্ছা শক্তিকে উজ্জীবিত করে তুলে। বঙ্গবন্ধু মাটি ও মানুষের নেতা। তাই তাঁর ভাষণে মাটি ও মানুষের কথা লক্ষ্য করা যায়। তিনি জনগণ ও শাসকশ্রেণির মনের ভাব বুঝতেন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসা বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ভাষণ, বক্তৃতা, সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে জনগণের সাথে তার যোগাযোগের ক্ষমতা ছিল অনবদ্য। সহজ-সাবলীলভাবে তার কথাগুলো জনগণকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন। ১ মার্চ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার পর তিনি ও তার দলের নেতা-কর্মীরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন ৭ তারিখের ভাষণের ব্যাপারে। বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে ডেকে বলেন, “আমি তো লিখিত বক্তব্য দেবো না; আমি আমার মতো করে দেবো। তুমি পয়েন্টগুলো ফরমুলেট কর।
ড. কামালের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সাথেও কয়েকবার বৈঠক করেন। ছাত্রনেতাদের সাথেও বৈঠক হয়। তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে। বঙ্গবন্ধু সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। মঞ্চে উঠে চিরাচরিত ভঙ্গিতে সম্বোধনের মাধ্যমে শুরু করেন তার বক্তৃতা। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি মোট ১১০৮টি শব্দ উচ্চারণ করেন। মিনিটে গড়ে ৪৮ থেকে ৫০টি শব্দ বের হয় তার মুখ দিয়ে।

 সে ভাষণে তিনি তুলে ধরেন শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস, সমসাময়িক হত্যাকাণ্ডের কথা, রাজনৈতিক দোলাচল এবং বাংলার মানুষের স্বায়ত্বশাসন লাভের বাসনাটি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি অলিখিত হলেও ভাষণের মাঝে তালপতন বা পুনরাবৃত্তির কোনো ঘটনা লক্ষ করা যায়নি। শব্দ চয়নের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন যথেষ্ট মার্জিত ও ধৈর্যশীল। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে তিনি সম্বোধন করেন ‘জনাব এহিয়া খান সাহেব’, ‘জনাব ভুট্টো সাহেব’ বলে।

শেষের কথাটি  ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’– ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডায়লগ যেটি শোনার জন্যেই শ্রোতারা মুখিয়ে ছিলেন। সবশেষে ‘জয় বাংলা’ বলে ভাষণটি শেষ করেছেন বঙ্গবন্ধু, যে স্লোগানটি পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। ৭ মার্চে রেসকোর্সের ভাষণের পরে নিউইয়র্কের দ্য নিউজউইক  ম্যাগাজিন ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করে।
৭ মার্চের ভাষণের সূচারুভাবে ব্যবচ্ছেদ করলে এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিকটি সমান্তরালভাবে চোখে পড়ে। শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সে ভাষণটি দেননি। বাঙালি সেদিন তার মাধ্যমে তাকে কেন্দ্র করে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। তাই, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ও বাণী ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্খার নিয়ন্ত্রক।

ভাষণে মূলত চারটি দাবি তোলা হয়– মার্শাল ল প্রত্যাহার, সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। তিনি বলেন, ‘দাবি পূরণের পরে আমরা ভেবে দেখবো অ্যাসেম্বলিতে বসব কিনা’। এ ধরনের কথা উচ্চারণ করে একদিকে বঙ্গবন্ধু আলোচনার পথ খোলা রাখলেন এবং ভাষণ পরবর্তী সৃষ্ট স্বায়ত্তশাসন দাবির আন্দোলনের দায়ভার থেকে নিজেকে এবং তার দলকে বাঁচিয়ে নিলেন।

তিনি একইসাথে উচ্চারণ করলেন ‘আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব’। অর্থাৎ, দাবি মানার জন্য অপ্রত্যক্ষ চাপও তৈরি করলেন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের কয়েকদিন আগে করা সংসদীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ণের সময় বিরোধী পক্ষের কেউ ন্যায্য দাবি করলে তারা সে দাবি মেনে নেবে। ৭ তারিখের ভাষণেও বঙ্গবন্ধু সে কথার পুনরাবৃত্তি করেন। এতে তার এবং আওয়ামী লীগের সহনশীলতার দিকটি উন্মোচিত হয়। বিশ্ব দরবারে বঙ্গবন্ধু একজন উদারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।

ভাষণের পরদিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সদর দপ্তরে রিপোর্ট জমা হয়, ‘চতুর শেখ মুজিব, চতুরতার সাথে বক্তৃতা করে গেলেন। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়ার দ্বায়িত্বও নিলেন না। নীরব দর্শকের ভূমিকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিল না।’ ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল প্রকৃতই সুচতুর ভাষণ।

উপযুক্ত সময়ে সঠিক দিকনির্দেশনা
৭ মার্চের ভাষণকে বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক দিকনির্দেশনা। পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা দেখেই আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ বুঝতে পেরেছিলেন যে কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে জাতীয় পরিষদে সরকার গঠন করতে দেবে না পশ্চিমারা। দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী দিশেহারা হওয়া শুরু করে। নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরাসরি স্বাধীনতার ডাকও দিতে পারছিল না আবার পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র মুখে বুজে সহ্য করাও ছিল কঠিন। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে একটি নির্দেশনামূলক ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাষণের শেষের দিকে ছিল তার নির্দেশমালা।

তিনি অসহযোগিতার ডাক দিলেন। কোর্ট-কাছারি, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলেও নিম্নবর্গীয় খেটে খাওয়া মানুষের যাতে কোনোপ্রকার অসুবিধা না হয় সেকারণে রিক্সা-ভ্যান, গরুর গাড়ি, রেল, লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দিলেন। ২৮ মার্চ সব সরকারি চাকুরেদের বেতন নিয়ে আসতে বললেন। গণযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি পাকিস্তানিরা আধিপত্য বিস্তার করে তাহলে সেখানে চাকুরিরত বাঙালিদের অফিস বয়কটের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে বিদেশি মিডিয়াগুলো যাতে বাংলার সঠিক অবস্থা বুঝতে পারে সেজন্য তাদের সাথে লিঁয়াজো রাখারও হুকুম দিলেন। এভাবে, সবক্ষেত্রে কর্মরত বাঙালিদের সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সামরিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন।

৮ মার্চ, ১৯৭১ সাল পরের দিন
আওয়ামী লীগের নেতাদের রিলিফ কমিটি ও সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ প্রদান করলেন। ভাষণের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিকটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এই উক্তিতে– ‘এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দ্বায়িত্ব আপনাদের।

যুদ্ধে জেতার জন্য অপ্রত্যক্ষ সত্যের আশ্রয় নেওয়ার প্রথা সুপ্রাচীনকালের। বঙ্গবন্ধুও ৭ মার্চের ভাষণে সেরকমই এক অপ্রত্যক্ষ সত্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেদিনের রেসকোর্সে সরাসরি সত্য বলাটা হতো আত্মঘাতীর সামিল। তিনি বললেন,

“প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে..।

তোমরা আমার ভাই… আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমায়ে রাখতে পারবে না।

মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সরাসরি না বলেও তিনি বাঙালিদের বুঝিয়ে দিলেন তার মনের কথা। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিরোধের নির্দেশনামা। বাঙালির মনের জোড় গেল বেড়ে। বাঙালি বুঝে গেল– কী করতে হবে সামনের দিনগুলোতে। পাকিস্তানিরাও হতভম্ব হয়ে রইল কিছুক্ষণ। বঙ্গবন্ধুর চাতুর্যময় রাজনৈতিক চালের বিপরীতে তারা চালল নগ্ন একটি চাল। নিরীহ এবং নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হল। শুরু হল মুক্তির সংগ্রাম।

তারিখ,৭/৩/২০২২

জনপ্রিয় সংবাদ

বোয়ালখালী’র লোকমানের বিরুদ্ধে দুদেকে অভিযোগ 

৭ ই মার্চ রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তোমরা আমার ভাই।

আপডেট সময় ০১:১২:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ মার্চ ২০২২

১৯৭১ সাল ৭ই মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন বাঙালি জাতি পেয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন বাণী,পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাঙালির মনের ইচ্ছা শক্তিকে উজ্জীবিত করে তুলে। বঙ্গবন্ধু মাটি ও মানুষের নেতা। তাই তাঁর ভাষণে মাটি ও মানুষের কথা লক্ষ্য করা যায়। তিনি জনগণ ও শাসকশ্রেণির মনের ভাব বুঝতেন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসা বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ভাষণ, বক্তৃতা, সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে জনগণের সাথে তার যোগাযোগের ক্ষমতা ছিল অনবদ্য। সহজ-সাবলীলভাবে তার কথাগুলো জনগণকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন। ১ মার্চ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার পর তিনি ও তার দলের নেতা-কর্মীরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন ৭ তারিখের ভাষণের ব্যাপারে। বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে ডেকে বলেন, “আমি তো লিখিত বক্তব্য দেবো না; আমি আমার মতো করে দেবো। তুমি পয়েন্টগুলো ফরমুলেট কর।
ড. কামালের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সাথেও কয়েকবার বৈঠক করেন। ছাত্রনেতাদের সাথেও বৈঠক হয়। তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে। বঙ্গবন্ধু সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। মঞ্চে উঠে চিরাচরিত ভঙ্গিতে সম্বোধনের মাধ্যমে শুরু করেন তার বক্তৃতা। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি মোট ১১০৮টি শব্দ উচ্চারণ করেন। মিনিটে গড়ে ৪৮ থেকে ৫০টি শব্দ বের হয় তার মুখ দিয়ে।

 সে ভাষণে তিনি তুলে ধরেন শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস, সমসাময়িক হত্যাকাণ্ডের কথা, রাজনৈতিক দোলাচল এবং বাংলার মানুষের স্বায়ত্বশাসন লাভের বাসনাটি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি অলিখিত হলেও ভাষণের মাঝে তালপতন বা পুনরাবৃত্তির কোনো ঘটনা লক্ষ করা যায়নি। শব্দ চয়নের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন যথেষ্ট মার্জিত ও ধৈর্যশীল। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে তিনি সম্বোধন করেন ‘জনাব এহিয়া খান সাহেব’, ‘জনাব ভুট্টো সাহেব’ বলে।

শেষের কথাটি  ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’– ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডায়লগ যেটি শোনার জন্যেই শ্রোতারা মুখিয়ে ছিলেন। সবশেষে ‘জয় বাংলা’ বলে ভাষণটি শেষ করেছেন বঙ্গবন্ধু, যে স্লোগানটি পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। ৭ মার্চে রেসকোর্সের ভাষণের পরে নিউইয়র্কের দ্য নিউজউইক  ম্যাগাজিন ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করে।
৭ মার্চের ভাষণের সূচারুভাবে ব্যবচ্ছেদ করলে এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিকটি সমান্তরালভাবে চোখে পড়ে। শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সে ভাষণটি দেননি। বাঙালি সেদিন তার মাধ্যমে তাকে কেন্দ্র করে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। তাই, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ও বাণী ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্খার নিয়ন্ত্রক।

ভাষণে মূলত চারটি দাবি তোলা হয়– মার্শাল ল প্রত্যাহার, সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। তিনি বলেন, ‘দাবি পূরণের পরে আমরা ভেবে দেখবো অ্যাসেম্বলিতে বসব কিনা’। এ ধরনের কথা উচ্চারণ করে একদিকে বঙ্গবন্ধু আলোচনার পথ খোলা রাখলেন এবং ভাষণ পরবর্তী সৃষ্ট স্বায়ত্তশাসন দাবির আন্দোলনের দায়ভার থেকে নিজেকে এবং তার দলকে বাঁচিয়ে নিলেন।

তিনি একইসাথে উচ্চারণ করলেন ‘আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব’। অর্থাৎ, দাবি মানার জন্য অপ্রত্যক্ষ চাপও তৈরি করলেন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের কয়েকদিন আগে করা সংসদীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ণের সময় বিরোধী পক্ষের কেউ ন্যায্য দাবি করলে তারা সে দাবি মেনে নেবে। ৭ তারিখের ভাষণেও বঙ্গবন্ধু সে কথার পুনরাবৃত্তি করেন। এতে তার এবং আওয়ামী লীগের সহনশীলতার দিকটি উন্মোচিত হয়। বিশ্ব দরবারে বঙ্গবন্ধু একজন উদারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।

ভাষণের পরদিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সদর দপ্তরে রিপোর্ট জমা হয়, ‘চতুর শেখ মুজিব, চতুরতার সাথে বক্তৃতা করে গেলেন। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়ার দ্বায়িত্বও নিলেন না। নীরব দর্শকের ভূমিকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিল না।’ ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল প্রকৃতই সুচতুর ভাষণ।

উপযুক্ত সময়ে সঠিক দিকনির্দেশনা
৭ মার্চের ভাষণকে বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক দিকনির্দেশনা। পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা দেখেই আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ বুঝতে পেরেছিলেন যে কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে জাতীয় পরিষদে সরকার গঠন করতে দেবে না পশ্চিমারা। দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী দিশেহারা হওয়া শুরু করে। নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরাসরি স্বাধীনতার ডাকও দিতে পারছিল না আবার পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র মুখে বুজে সহ্য করাও ছিল কঠিন। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে একটি নির্দেশনামূলক ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাষণের শেষের দিকে ছিল তার নির্দেশমালা।

তিনি অসহযোগিতার ডাক দিলেন। কোর্ট-কাছারি, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলেও নিম্নবর্গীয় খেটে খাওয়া মানুষের যাতে কোনোপ্রকার অসুবিধা না হয় সেকারণে রিক্সা-ভ্যান, গরুর গাড়ি, রেল, লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দিলেন। ২৮ মার্চ সব সরকারি চাকুরেদের বেতন নিয়ে আসতে বললেন। গণযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি পাকিস্তানিরা আধিপত্য বিস্তার করে তাহলে সেখানে চাকুরিরত বাঙালিদের অফিস বয়কটের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে বিদেশি মিডিয়াগুলো যাতে বাংলার সঠিক অবস্থা বুঝতে পারে সেজন্য তাদের সাথে লিঁয়াজো রাখারও হুকুম দিলেন। এভাবে, সবক্ষেত্রে কর্মরত বাঙালিদের সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সামরিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন।

৮ মার্চ, ১৯৭১ সাল পরের দিন
আওয়ামী লীগের নেতাদের রিলিফ কমিটি ও সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ প্রদান করলেন। ভাষণের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিকটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এই উক্তিতে– ‘এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দ্বায়িত্ব আপনাদের।

যুদ্ধে জেতার জন্য অপ্রত্যক্ষ সত্যের আশ্রয় নেওয়ার প্রথা সুপ্রাচীনকালের। বঙ্গবন্ধুও ৭ মার্চের ভাষণে সেরকমই এক অপ্রত্যক্ষ সত্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেদিনের রেসকোর্সে সরাসরি সত্য বলাটা হতো আত্মঘাতীর সামিল। তিনি বললেন,

“প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে..।

তোমরা আমার ভাই… আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমায়ে রাখতে পারবে না।

মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সরাসরি না বলেও তিনি বাঙালিদের বুঝিয়ে দিলেন তার মনের কথা। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিরোধের নির্দেশনামা। বাঙালির মনের জোড় গেল বেড়ে। বাঙালি বুঝে গেল– কী করতে হবে সামনের দিনগুলোতে। পাকিস্তানিরাও হতভম্ব হয়ে রইল কিছুক্ষণ। বঙ্গবন্ধুর চাতুর্যময় রাজনৈতিক চালের বিপরীতে তারা চালল নগ্ন একটি চাল। নিরীহ এবং নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হল। শুরু হল মুক্তির সংগ্রাম।

তারিখ,৭/৩/২০২২