শস্য শ্যামল ভরা তানোরের বুকে সবুজের গালিচায় ঢেকেছে বিস্তৃর্ণ ধানের ক্ষেত। ধান সিঁড়ি ক্ষেত আরো কত আছে অন্য জনপদে তবে ভূবৈচিত্রের কারণে তানোরের ধানক্ষেত অন্য জনপদের চাইতে আলাদা। ধানসিঁড়ি নামে নদীর কথা পড়েছি নিসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় তাইতো কবিতার মতো সুন্দর তানোরের এই ধানসিঁড়ি ক্ষেত। তানোরের ধানসিঁড়ি ক্ষেত সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে বিন্যস্ত নাম তাই ধানসিঁড়ি ক্ষেত। এখানকার জমি কোথাও উঁচু কোথাও নিচু আইল দিয়ে সীমানা দেওয়ায় ধাপ তৈরি হয়েছে সিঁড়ির মত। তানোরে ধানসিঁড়ি ক্ষেতের সমবায়ে গড়া মোট আবাদি জমির পরিমাণ ২২৬৫৬ হেক্টর। একেতো উর্বর জমি তার উপর জল সেচের সুবিধা আছে। বছরে দুই থেকে তিন বার ফসল ফলায় কৃষাণ-কৃষাণীরা। শুধু ধান নয় গম, মসুর, ভুট্টা , সরিষা নানা শস্যের ফলন ফলে এই জনপদে।ভূবৈচিত্র জনপদে জীবন ধারার বৈচিত্র না থাকলে মানায় তাইতো তানোরের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীরা আবহমানকাল ধরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছে এ জনপদে । তানোরে এই যে ভুমি রূপের ভিন্নতা আর অফুরান উর্বরতা এর কৃতিত্ব আসলই বরেন্দ্রভূমির। বরেন্দ্র ভূমি অঞ্চল উত্তর বঙ্গের সবচেয়ে বড় এলাকা । প্রাচীন পলিমাটিতে গড়া বরেন্দ্র ভূমি উত্তর বঙ্গের প্রায় ৭৭৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠা এই বিশাল ভুমির মাঝে রাজশাহী জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত ছোট একটি অংশ দখল করে আছে এই তানোর জনপদ। তানোরে কৃষিকাজের সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় ৪৫ ভাগ বাসিন্দা। তানোরে ধানের প্রাচুর্য বেশি বলে গৃহস্থ বাড়ির ঢিকির ধাপুর,ধুপুর ছন্দ তুলে নিত্যদিন। বংশপরম্পরায় আবহমানকাল ধরে তারা এ ঐতিহ্য ধরে আসছে । তানোর জনপদ মৃত্তিকা ঘনিষ্ঠ জীবন তাইতো ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি মৃৎ পাত্রের এখনো সমান কদর এখানে। এখানকার মানুষ জন বেশ সহজ সরল আর মিশুক স্বভাবের। তানোরে বসবাস করা মোট বাসিন্দাদের বেশিরভাগেরই ঠাই এই মমতামাখা গ্রামে। তানোর উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় মোট ১২৭টি ( সরকারি ৪৯টি বেসরকারি ৭৮টি ) তানোরে মোট শিক্ষার গড় হার ৪৮ ভাগের বেশি। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তানোর থানা জনপদ ১১৪ বছর পর ১৯৮৩ সালে রূপান্তরিত হয়েছে উপজেলায় । এই উপজেলায় বেচা কেনার হাঁট আছে ১৫ টি মত কোনোটা সাপ্তাহিক হাঁট কোন টা আবার দৈনন্দিন হাঁট। তানোর হাঁট বাজার গুলোর মধ্যে সবথেকে নামকরা মুণ্ডমালা , কামারগাঁ, নারায়ণপুর, গোল্লা পাড়া ও কালিগঞ্জ হাট । কালিগঞ্জ হাটে কোথাও নিত্যপণ্যের রকমারি আয়োজন কোথাও আবার পেট পূর্তির মনোরম আয়োজন । কালিগঞ্জ হাঁটে এক পাশে বসে কর্মকারদের কামার শালার। কামারের মূল যন্ত্র হাঁপর , হাঁপরের জোরালো বাতাস পেয়ে কয়লা পুড়ে দড়ি টানলে। প্রায় বারোশো ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপে পুড়ে লাল হয় লোহা। এই হাঁটের কামাররা কর্মকারের কাজ করছে প্রায় চার পুরুষ ধরে।প্রাচীন বাংলায় যখন থেকে কৃষিকাজের সূত্রপাত ঘটেছে তখন থেকেই চলছে এই লোহার কারিগরি। আমাদের কৃষি ভিত্তিক সভ্যতায় কামার নামের এই কারিগরের অবদান অনেক। আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও এর উপযোগিতা ফুরিয়ে যায়নি ওদের। দা-কুড়াল, কাস্তে-হাতুড়ি, লাঙ্গলের ফলা সহ প্রায় ২৫ রকম কাজের হাতিয়ার যোগান দিয়ে স্থানীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই হাঁটের কামাররা । বরেন্দ্রভূমি তানোরের কাঁচা পথে ঐতিহ্যবাহী মহিষের গাড়ি এখনোও মাধুরী মিলাই এই জনপদের রাস্তাঘাটে।ভূবৈচিত্রের জনপদে জীবনধারার বৈচিত্র না থাকলে কি মানায়, মানায় না বলেই তো তানোরে বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো,মাহালী আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাথে একে অপরের বসবাস জেনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন মেলা।তানোর উপজেলার প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন বিহারৈল বিবি,কুঠিপাড়ার নীল কুঠি, মাদারীপুরের পাগলা শাহ`র মাজার,ও ধানোরা ঢিবি, সিধাইড়ের সুলতানী আমলের মসজিদ গোল্লাপাড়ার বদ্ধ ভুমি উল্লেখযোগ্য। তানোরে ক্ষুদ্রনৃ জনগোষ্ঠীর মাঝে সাঁওতালরা পরিচিতি বেশি এ জনপদে। সাঁওতাল পাড়া মানে মাটির ঘর বাড়ি আর মাটি ঘেঁষা জীবন। সাঁওতাল মেয়েরা মাটি মিশানো রং দিয়ে রঙিন করে তাদের ঘরবাড়ি। প্রতিদিনের ঘরকন্যায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কে প্রাধান্য দেয় সাঁওতাল মেয়েরা। পরিচ্ছন্নতা আর নকশি রঙে আঁকা সাঁওতালদের ঘর বাড়ি আসলেই দেখার মত। কৃষিজীবী হওয়ায় বাঙ্গালীদের মত সাঁওতালদের প্রধান খাবার মাছ ,ভাত আর শাকসবজি। কাজের বেলায় সাঁওতালরা বয়সের হের, ফের মানে না। পরিশ্রমী বলে সাঁওতালদের যে সুনাম তা ছেলেদের চাইতে মেয়েদের বেশি। জমিতে ধান লাগানো থেকে শুরু করে ধান কাটা ও মাড়া পর্যন্ত মেয়েরা করতে পারে। সাঁওতালরা নিজেদের বাড়িঘর তারা নিজেরাই তৈরি করতে পারে তাদের ঘরবাড়ি তৈরির মূল উপাদান বরেন্দ্র ভূমির এঠোল মাটি।তানোর পাঁচনদন ইউনিয়নের জিনা পাড়া গ্রামটি মাহালীদের । সাঁওতালদের মত মাহালীরাও তানোরের ক্ষুদ্রনৃ গোষ্ঠী। কেউ, কেউ কৃষি কাজ করলেও তাদের মূল পেশা বাঁশের কাজ । প্রাচীন আদিবাসী সম্প্রদায়ের তানোরে আরেকটিগ্রাম আছে রাজবংশীদের গ্রামের নাম রামপুর ট্যাকনা পাড়া তানোর উপজেলা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বাঁধাইর ইউনিয়নে । সাঁওতাল এবং মাহালীদে মত রাজবংশীরা পেশায় কৃষিজীবী। ধর্মীয় সংস্কার এবং জীবিকার প্রয়োজনে রাজবংশীরা গরুসহ গৃহপালিত পশু পালন করে খুব যত্ন সহকারে। ক্ষুদ্রনৃ গোষ্ঠী হলেও সমতল ভূমির বাসিন্দা হওয়াই জীবনধারা ওদের বাঙ্গালীদের মত।সাঁওতালদের মত রাজবংশীরা কবুতর পালে মাটির হাঁড়িতে, নিজেরাও বসবাস করে পরিবেশ বান্ধব মাটির ঘরে। রাজবংশী নামটি নামকরণ হয়েছে রাজবংশ থেকে। ধারণা করা হয় রাজবংশীরা কোচ বংশীয় কর্তৃক । কোচ রাজা হাজো বংশধররা দিনে দিনে পরিচিতি পেয়েছে রাজবংশী নামে। তানোরের যেখানেই যাই না কেন পিছু ছাড়ে না সবুজের মায়া । বরেন্দ্র জনপদ তানোর আসলেই পয়মন্ত জনপদ। বর্ণিল জীবন প্রকৃতির ঐশ্বর্য আর শস্যের প্রাচুর্যে ভরা তাই তো স্নিগ্ধ , সুন্দর, মায়াবী ধানসিঁড়ির ক্ষেত বরেন্দ্রভূমি অঞ্চল তানোর । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতায় বলেনবহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে, বহু ব্যয় করি,বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।দেখা হয় নাই চক্ষু মিলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু ।কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আসলেই আমাদের দেখা হয় না অনেক কিছু ।তানোর জনপদ যেন ঐতিহ্যের আনন্দের ছটায় বৈচিত্রের বুননে আসলেই অপরূপ আমার বাংলাদেশের এই বরেন্দ্রভূমি অঞ্চল রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলা জনপদ।তারিখ,৫/৩/২০২২
Attachments area