প্রত্যেক অপমৃত্যুতে পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তের সময় চিকিৎসকের কথায় নিহতের মরদেহের নমুনা সংগ্রহ করা হয় মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য। আলমত সংগ্রহ করতে ময়নাতদন্তের সব কাজ সম্পন্ন করেন ডোমেরা (যারা চিকিৎসকের উপস্থিতিতে মরদেহ কাটাছেঁড়া করে)। নিহত নারী হোক আর পুরুষ রাজশাহী বিভাগের সব হাসপাতালগুলোতে ময়নাতদন্ত করেন পুরুষ ডোম।
নারীদের স্বজনেরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি সব জায়গায় নারীরা কাজ করছেন। এমনকি মৃত নারীদের মরদেহ উদ্ধারে কাজও করেন নারীরা। কিন্তু নারীদের ময়নাতদন্তের কাজ করছেন পুরুষেরা। নিহত নারীর ক্ষেত্রে নারী ডোম দিয়ে ময়নাতদন্ত করা দরকার। প্রতিটি হাসপাতালে নারীদের ময়নাতদন্তে নারী ডোম নিয়োগের দাবি জানান তারা।
ময়নাতদন্তের জন্য নারী ডোমের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার সদর হাসপাতালের অধিকাংশ ডোম জানান, নারীদের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে আমাদের স্যান্টিমেন্টে (বিবেকে) লাগে। সবারই তো মা-বোন আছে। তবে প্রতিটি হাসপাতালে নারী ও পুরুষ উভয় ডোম থাকলে ভালো হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে পুরুষ, আর নারীদের ক্ষেত্রে নারী ডোম ময়নাতদন্তের কাজ করবেন। এজন্য কোনো কোনো সময় নারীদের ময়নাতদন্ত নিয়ে নিহতের স্বজনেরা আপত্তি জানায়।
২০২২ সালের শুরুর দিকে কিটনাশক পানে মৃত্যু হয় মোহনপুর উপজেলার কইকুড়ি গ্রামের মীম খাতুনের। পরে পুরুষ ডোম দিয়ে তার ময়নাতদন্ত হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। বোনের ময়নাতদন্ত নিয়ে মো. মাসুম বলেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য নারী চিকিৎসক রয়েছে। প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে নারীদের জন্য নারীরা রয়েছেন। আর হাসাপাতালে পুরুষ ডোম নারীদের ময়নাতদন্ত করে। হাসপাতালে নারী ডোম থাকলে ভালো হয়। নারীরা নারীদের ময়নাতদন্ত করবেন। আর পুরুষেরা পুরুষদের ময়নাতদন্ত করবেন।
শুধু মীম নয়, প্রতিদিনই বিভিন্ন হাসপাতালে নারীদের ময়নাতদন্ত হচ্ছে। এই সব ময়নাতদন্তগুলো পুরুষ ডোমেরাই করে থাকেন।
তবে নারীরা কি ডোম পেশায় আসবেন? এমন কথার উত্তরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ডোম শ্রী দিপন কুমার বলেন, তাদের স্বজাতির দুই নারীর কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। তারা ময়নাতদন্তের কাজে করতে আগ্রহী। তাই নিজেদের কাগজপত্র দিয়েছে। এই নারীর কাগজগুলো মেডিকেলে কলেজে জমা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের ময়নাতদন্তের কাজগুলো শিখিয়ে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের ডোমের কাজ করা শ্রী তপন দাস বলেন, নারী ডোম অবশ্যই দরকার। নারীদের ময়নাতদন্ত নারীরা করবে। দেখেন ডাক্তার নারী হচ্ছে, নার্স নারী হচ্ছে। এই নারীরাই বড় বড় অপারেশন করছে। তারা শিখেছে বলেই করতে পারছে। তাহলে কেন নারীরা ময়নাতদন্ত করতে পারবে না। তাদের শিখিয়ে দিলে তারাও ময়নাতদন্ত করতে পারবে। নারী ডোম নিয়োগের বিষয়টি আমরা কর্তৃপক্ষকে বলেছি। এখন পর্যন্ত কারো নিয়োগ হয়নি।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের অধ্যক্ষ নওশাদ আলী বলেন, আমাদের হাসপাতালে কোনো নিয়োগপ্রাপ্ত ডোম নেই। আউট সোর্সিংয়ে একজনকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এই হাসপাতালে কোনো নারী ডোম নেয়। দুইজন নারী ও দুইজন পুরুষ ডোম নিয়োগের জন্য প্রায় ১০ বছর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ডোম নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো ডোম নেই। তবে রানা আহমেদ নামের একজন পরিচ্ছন্নকর্মী ২০১৪ সাল থেকে ডোমের কাজ করেন। ডোম রানা আহমেদ বলেন, অন্য কোনো ডোম নেই। এমনকি নারী ডোমও নেই। ডাক্তারদের সঙ্গে সব কাজ আমাকেই করতে হয়। আমাকে ২০১৪ সাল থেকে কল অর্ডারে ডোম হিসেবে কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে ডোমের কাজ করছি।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রতন কুমার রায় বলেন, এখানে ডোমের পোস্ট খালি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে কাউকে এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যার কারণে হাসপাতালের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দীর্ঘদিন হলো ডোমের কাজ করছে। এছাড়া এখানে কোনো নারী ডোম না থাকায় পুরুষ ডোমকেই নারীদের ময়নাতদন্ত করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পদ খালি থাকলেও সেটা নারী না পুরুষ এটা উল্লেখ নেই। বিষয়টি বহুবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। যেহেতু সিরাজগঞ্জে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়েছে তাই নিয়মানুযায়ী ময়নাতদন্তগুলো তাদেরই করার কথা। কিন্তু তারা সেটা না করে সব আমাদের কাছেই পাঠিয়ে দেয়।
অপর জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের ডোম মিতুল কুমার দাস বলেন, জেলা হাসপাতালে কোনো নারী ডোম নেই। নারীদের কাটাছেঁড়া আমি করি। তবে উপায় না থাকায় বাধ্য হয়েই করতে হয়।
বিষয়টি নিয়ে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাসুদ পারভেজ জানান, একজন পুরুষ ডোম দিয়েই চলছে ময়নাতদন্তের কাজ। এছাড়া এখানে নারী ডোম নেয়।
এছাড়া পাবনা জেনারেল হসপাতালে ডোমের কাজ করেন দেবদাস চন্দ্র দেবু (৩৮)। তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত ডোম। বাবা, দাদা এই ডোমের কাজ কররেন। তারা মারা যাওয়ার পরে এখন দেবু এই কাজ করেন।
এ বিষয়ে ডোম দেবদাস চন্দ্র দেবু জানান, তাদের এখানে নারী ডোম নেই। বাবা, দাদারা যেভাবে শিখিয়েছেন সেই ভাবে ডোমের কাজ করেন তিনি। সব নিহতকে মা-বোন ভেবেই ময়নাতদন্তের কাজ করি। তবে নারী ডোম হলে ভালো হয়। হাসপাতালগুলোতে নারীদের ময়নাতদন্তের জন্য নারী ডোম নিয়োগ দেওয়া দরকার। ময়নাতদন্তের সময় ডাক্তার (চিকিৎসক) থাকে। ভিক্টিম নারী হলে নারী ডাক্তার ও পুরুষ হলে পুরুষ ডাক্তার থাকে।
বিভাগের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের (শজিমেক) তিন জন ডোমের বিপরীতে কর্মরত আছেন দুই জন। তারা হলেন রবিনাথ ও দিলীপ। মরদেহ কাটার কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দিলীপ করতেন। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। দিলীপের পরিবর্তে তার ভাই শজিমেক হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রতন মরদেহ কাটার কাজ করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শজিমেক অধ্যক্ষ ডা. রেজাউল আলম জুয়েল বলেন, মরদেহ কাটার কাজে এই দুজন আছেন বর্তমানে। কোনো নারী ডোম নেই।
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল মর্গের ডোম পুতরা বলেন, ১৫ বছর যাবত এই মর্গে লাশ কাটছি। ৪ বছর হলো চাকরি সরকারিকরণ হয়েছে। আগে বেতন না পেলেও এখন প্রতি মাসে ১৭ হাজার ৮০০ টাকা বেতন পাচ্ছি। মর্গে আমি ছাড়া আর কোনো ডোম নেই। তাই এখানে আসা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের মরদেহ আমাকেই কাটতে হয়। এতে অনেক নিহতের স্বজন আপত্তি জানায়। যদি একজন নারী ডোম থাকতো সেক্ষেত্রে সুবিধা হতো।
বিষয়টি নিয়ে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও-ভারপ্রাপ্ত) ডা. আবু আনছার আলী বলেন, বর্তমান সময়ে ১৬ থেকে ৩২ বছর বয়সী নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। ওইসব নারীদের মরদেহ মর্গে আনার পর পুরুষ ডোম দিয়ে পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে নিহতের স্বজনরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপত্তি জানায়। এরপরেও কিছুই করার থাকে না।
তিনি আরও বলেন, অল্প বয়সী নারীদের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে পুরুষ ডাক্তাররাও বিব্রতবোধ করেন। তাই দেশের প্রতিটা হাসপাতালের মর্গে পুরষদের পাশাপাশি সরকারিভাবে নারী ডোম নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
অপরদিকে নাটোর অধুনিক সদর হাসপাতালে ডোম প্রবন কুমার মারা যাওয়ার পরে তার ছেলে জীবন কুমার ডোমের কাজ করেন। জীবন কুমার দুই বছর ধরে এই হাসপাতালটিতে ডোমের কাজ করছেন।
ডোম জীবন কুমার বলেন, অনেক নারীদের ময়নাতদন্ত করতে হয়। কখনও কোন নারীর অভিভাবক ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তবে নিজের খারাপ লাগে। সবারই তো মা বোন রয়েছে। নারী ডোম হলে ভালো হয়। আমি পুরুষদের ময়নাতদন্তগুলো করলাম। নারী ডোম থাকলে সে নারীদের ময়নাতদন্তগুলো করলো।
নাটোর অধুনিক সদর হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক (দায়িত্ব প্রাপ্ত) সিভিল সার্জন ডা. মুহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, নাটোর অধুনিক সদর হাসপাতালে ডোম পোস্ট একটি। ডোম প্রবণ কুমার প্রায় ৩০ বছর কাজ করছেন। তিনি বেঁচে থাকা অবস্থা তার ছেলে জীবন কুমার এই কাজ শুরু করে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১১ ডিসেমব্র মারা যায়। দুই বছর থেকে জীবন কুমার ডোমের কাজ করছেন। তাকে আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে নারী ডোম নেই।
এছাড়া জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. শহীদ হোসেন জানান, এখানে নিয়োগপ্রাপ্ত ডোম রয়েছেন। তবে তার চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে। এছাড়া এখানে কোনো নারী ডোম নেই।
এ বিষয়ে কথা বলতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ফরেন্সিক চিকিৎসক ডা. কফিল উদ্দিনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে পারেননি। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় হাসপাতালের সাবেক ফরেন্সিক চিকিৎসক মনসুর রহমানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন, আর সামাজিকভাবেই বলেন নারী ডোম দরকার। বর্তমানে ধর্ষণ ছাড়াও নারীদের বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষাগুলো নারীদের দিয়ে করানো হয়। ময়নাতদন্তের বিষয়গুলো ভীতিকর। তাই এই কাজে নারী আসতে চাই না।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আনারুল কবীর বলেন, হাসপাতালগুলোতে পুরুষ ডোমের সঙ্কট রয়েছে। তারপরে নারী ডোম নিয়োগের বিষয়টি ভালো বলেছেন। আসলে এই পেশায় নারীরা আসবে কি না এটা একটা ব্যাপার। হাসপাতালগুলোতে নারী ডোম নিয়োগের বিষয়টি যথাযথ জায়গায় জানানো হবে।