স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি অনেকেই টের পাচ্ছেন না। জানার আগেই তা ছড়িয়ে পড়ছে আরেকজনের শরীরে। কেউ জেনেও গোপন রাখছেন সামাজিক নিগ্রহের ভয়ে। আবার এই ভাইরাসের চিকিৎসাসেবা চালু হলেও তা এখনো অনেকেরই অজানা। এতেই মূলত উদ্বেগ বাড়ছে! বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণঘাতী এইচআইভি নিরাময়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আরও বেশি পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে রাজশাহীতে এইডস শনাক্তকরণের ব্যবস্থা থাকলেও এর চিকিৎসাসেবা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য রোগীদের পাশের জেলা বগুড়ামুখী হতে হয়। তবে সম্প্রতি সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, অচিরেই রাজশাহীতেও এইডসসের চিকিৎসা চালু করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
একাধিক বেসরকারি সংস্থার গণমাধ্যমে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী জেলাসহ উত্তরাঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এইচআইভিতে আক্রান্তের সংখ্যা। পরিসংখ্যান মতে, রাজশাহীতে ২০১৯ সালে ঘাতক এই ভাইরাস ধরা পরে চার জনের শরীরে। তার দু’বছর পর; অর্থাৎ ২০২১ সালে শনাক্ত হন সাতজন। পরের বছর ২০২২ সালে নতুন করে আরও ১২ জন আক্রান্ত হন এইচআইভিতে।
সম্প্রতি বেসরকারি মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশন জানিয়েছে, রাজশাহীতে বর্তমানে এইচআইভি পজেটিভ রোগীর সংখ্যা ১৯ জন। অতএব, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে এইচআইভি পজেটিভ রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ! সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের এইচটিসি বিভাগের সূত্র বলছে, এইচআইভি পজেটিভের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যা সমকামীদের। এছাড়াও এ তালিকায় আছে উভকামী বা বহুগামী পুরুষেরাও। এরপরই আছে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী। শেষের ধাপে আছে রক্ত, মায়ের বুকের দুধ, স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা এবং ইঞ্জেকটিভ ড্রাগের মাধ্যমে সংক্রমিত ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম এইচআইভি আক্রান্ত রোগী ধরা পরে ১৯৮৯ সালে। এরপর থেকে ১০, ৫০, ১০০ বা ৩০০ জন করে নতুন রোগী প্রতিবছর শনাক্ত হয়েছে। গণমাধ্যমে বেসরকারি সংস্থা লাইট হাউসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত সারাদেশে এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মোট ৯ হাজার ৭০৮ জনে। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৮২০ জন। ২০২২ সালে সারাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪৭ জন। একই বছরে মৃত্যু হয়েছে মোট ২৩২ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে এইচআইভিতে মৃত্যুর হার ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এইডস রোগীদের চিকিৎসার আওতা আনতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। গ্রহণ করা হয়েছে হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আশা করা হচ্ছে, সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ হলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৯৫ শতাংশ এইডস রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
এদিকে রাজশাহীতে এইচআইভি পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকলেও এর চিকিৎসার জন্য এখনো কোন আলাদা সেন্টার চালু হয়নি। তবে তিন বছরের বেশি সময় ধরে বগুড়ার শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে চালু হয়েছে এইডসের চিকিৎসা। সেখানেই মূলত চিকিৎসা নিচ্ছেন রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলার এইচআইভি পজেটিভ ও এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফ.এম শামীম আহাম্মদ বলেন, “এইচআইভি রোগী শনাক্তকরণের জন্য রামেক হাসপাতালের আউটডোরে একটি এইচটিসি (এইচআইভি-এইডস) টেস্টিং সেন্টার আছে। সেখানে কারও শরীরে এইচআইভির উপস্থিতি আছে কিনা; তা পরীক্ষা করা হয়। তবে রামেক হাসপাতালে এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা বা আলাদা সেন্টার নেই। চকিৎসার জন্য কেন্দ্র হচ্ছে বগুড়া। বগুড়ায় একটি স্পেশাল ট্রিটমেন্ট সেন্টার আছে, সেখানে থেকেই মূলত চিকিৎসা প্রদান করা হয়।”
তবে অচিরেই রাজশাহীতেও এইচআইভি রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা সেন্টার চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, ব্যাপারটি পুরোপুরি সঠিক নয়। উত্তরবঙ্গে প্রথম সেন্টার চালু করা হয়েছে বগুড়ায়। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জে এবং বর্তমানে রাজশাহীতেও চালু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রাজশাহীতে এটি হয়ে গেলে তখন আর রোগীদের বগুড়ায় যেতে হবে না।”
এইচআইভি নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের উদ্যোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, “মানুষকে সামাজিকভাবে সচেতন করার জন্য সরকারের পক্ষে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষকে সচেতন বার্তা দেয়া হয়। এমনকি রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারেও এইচআইভি সংক্রান্ত সচেতনতা সম্পর্কে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। কারাগারে বিশেষ করে যাদের টিবি ধরা পড়ে; তাদেরকে আগে এইচআইভি পরীক্ষা করানো হয়।”
এইডস বিষয়ে রাজশাহীতে এখনো সচেতনতা কাঙ্খিত পর্যায়ে নেই বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে, ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়ছে। এটিকে আরও বৃদ্ধি করার পরামর্শ তাদের। এনিয়ে জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ রাজশাহী জেলার সভাপতি অধ্যাপক চিন্ময় কান্তি দাস সোনালী সংবাদকে বলেন, “বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত গুরুতর! এর নেপথ্যের কারণগুলোতে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ থাকায় মানুষ বিভিন্নভাবে গোপনে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। এটি নিরাময়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বিভিন্ন জায়গায় প্রচার-প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ বেশি করে নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের স্কুলগুলোতে যৌন স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কোনরকম উন্মুক্ত আলোচনা দেখি না। এটি বেশ জরুরি। কারণ, সমাজে এটি যেভাবে বিস্তার লাভ করছে, এটি রোধ করতে হলে সঠিক যৌন শিক্ষা বিষয়ে সামাজিক সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।”
এইচআইভি পরীক্ষায় অনীহার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “অনিহাটার মূল কারণ হচ্ছে এইচআইভি বা যৌন এই ব্যাধিটিকে সামাজিকভাবে আমরা গর্হিত একটি কাজ হিসেবে মনে করি। তাই কেউ যদি এতে আক্রান্ত হন, তিনি সামাজিক নির্গহের ভয়ে প্রকাশ করতে চান না। কারণ সামাজিকভাবে আমরা এটিকে গ্রহণ করি না। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সবার মধ্যে ধারণা সৃষ্টি করা। এ ব্যাপারে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।”
রাজশাহীতে এইচআইভির আলাদা সেন্টার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে চিন্ময় কান্তি দাস আরও বলেন, “বিভাগীয় শহর হিসেবে রাজশাহীতে জরুরিভাবে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত। কারণ আমাদের বুঝতে হবে; বিষয়টি অত্যন্ত সাংঘাতিক! যেহেতু এটি পর্দার আড়ালে ঘটছে. আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই, সেহেতু এটিকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এটিকে যদি রোধ করা না যায় তাহলে শুধু এইচআইভিই নয়, আরও অন্যান্য অনেক ভয়াবহ যৌন সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই মাঠ পর্যায়ে যৌন শিক্ষামূলক সচেতনতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে কেউ যদি এতে আক্রান্ত হন, তাকে তাৎক্ষণিকভাবে যেন শনাক্ত করা যায় এবং পরবর্তীতে তার চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়; সেটিও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।”