মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল, সেটিকে ‘কাটাছেঁড়া’ করায় আক্ষেপ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর দায় তিনি দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আসা বক্তব্যের মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে এই বক্তব্য এল।
শুক্রবার দুপুরে সিলেট মহানগর বিএনপির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, “এই সরকারের অপকীর্তি বলে শেষ করা যাবে না। তাদের একটাও ভালো কাজ নেই। তারা এই দেশের সমাজকে দুই ভাগে পুরোপুরি বিভক্ত করে ফেলেছে এবং একটা দূষিত সমাজে পরিণত করেছে।
“একটি বড় ক্ষতি হচ্ছে, আমাদের যে সংবিধান ১৯৭২ সালে এই দেশের মানুষ রচনা করেছিল, যে সংবিধান সবাই মেনে নিয়েছিল, সেই সংবিধানকে তারা বারবার কাটাছেঁড়া করে একটা অকার্যকর সংবিধানে পরিণত করেছে।”
মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রচনা হয় দেশের প্রথম সংবিধান। তাতে চার মূলনীতি ছিল: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।
এর মধ্যে বিএনপি স্পষ্টতই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পক্ষে নয়। এই সংবিধানের আলোকে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হলেও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময় সে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়।
এখন পর্যন্ত সংবিধানে মোট ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে হয় তিনটি সংশোধনী। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে করেন একটি, তাকে হত্যার পর বিএনপির আমলে হয় আরও একটি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর সংশোধনী আসে চারটি। তার পদত্যাগের পর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতি হয়ে নির্বাচন শেষে আবার পদে পাওয়ার বিষয়টি বৈধতা দেওয়ার জন্য আসে আরও একটি সংশোধনী।
খালেদা জিয়ার দুই বারের মেয়াদে সংবিধান সংশোধন হয় মোট তিন দফা। আর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর হয় আরও তিনটি সংশোধনী।
এর মধ্যে ষোড়শ সংশোধনীতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে নিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের বিধানে ফিরে আসে। বিএনপি এর তীব্র বিরোধিতা করে।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় বাকশাল কায়েমের কথা তুলে ধরে এর তীব্র সমালোচনা করেন ফখরুল।
তিনি বলেন, “বাহাত্তরের সংবিধানে যে মৌলিক বিষয় ছিল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটা জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, সেটাকে ১৯৭৫ সালে তারা ধ্বংস করে দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল গঠন করেছিল।
“যখনই তারা সুযোগ পেয়েছে ক্ষমতায় আসার তখনই তারা সংবিধানকে ধ্বংস করেছে, তখনই তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হাত দিয়েছে, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করেছে, কণ্ঠরোধ করেছে সংবাদপত্রের।”
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের বক্তব্য নিয়েও কথা বলেন ফখরুল। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষ কেউ বিশ্বাস করে? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, তারা বিশ্বাস করে?”
তখন নেতা-কর্মীরা ‘না’ বলে আওয়াজ দেন।
এরপর মির্জা ফখরুল বলেন, “সরকার একটা ভয়ের রাজত্ব, ত্রাসের রাজত্ব তারা তৈরি করেছে।… যে সরকার আমাদের সমস্ত অর্জন কেড়ে নিয়েছে, তাদের যে কোনো উপায়ে পরাজিত করতে হবে। তাদেরকে বিতাড়িত করতে হবে। দেশে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে।”
‘ধ্বংস হওয়া অর্থনীতি টেনে তোলা কঠিন’
আওয়ামী লীগ দেশের অর্থনীতিকে ‘ধ্বংস করে ফেলেছে’ বলেও অভিযোগ বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, “অর্থনীতিকে তারা এমনভাবে ধ্বংস করেছে যে এটাকে টেনে তোলা অত্যন্ত কঠিন। শুধু নিজেদের স্বার্থে, দুর্নীতির স্বার্থে আজ তারা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা মেগাপ্রকল্পের ব্যয় ও প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ফখরুল। তিনি বলেন, “তারা নাকি অনেক উন্নয়ন করেছে। এই উন্নয়নটা কার জন্যে? এই উন্নয়ন গুটিকতক মানুষের জন্য।
“তারা পাতাল রেল করছে, মেট্রোরেল করেছে। কত টাকা খরচ হয়েছে? যা খরচ হওয়ার কথা তার চেয়ে তিনগুণ খরচ করেছে।
“পদ্মাসেতু করে খুব বাহবা নেয় তারা। সেই পদ্মাসেতু বানাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল। সেটা ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। চট্টগ্রামে টানেল তৈরি করেছে, যার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না আমরা জানি না।
“অথচ হাসপাতালে আমার রোগীরা ঠিকমত বেড পায় না, ওষুধ পায় না, তারা ডাক্তার পায় না। হাসপাতালে ঢোকার মতো কোনো পরিবেশ থাকে না। স্বাস্থ্যসেবার জন্য বেশিরভাগ মানুষকে বাইরে চলে যেতে হচ্ছে, ভারতে যেতে হচ্ছে।”
আইন শৃঙ্খলার ‘এত অবনতি!’
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ের কথা তুলে ধরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কত খারাপ হয়েছে! প্রকাশ্যে দিনের বেলায় চড়-থাপ্পড় মেরে ১১ কোটি টাকা নিয়ে যায়!
“পরে আবার ওরাই খুঁজে পায়, তার মধ্যে আবার দুই কোটি টাকা পাওয়া যায় না! আইনশৃঙ্খলা এমন খারাপ হয়েছে, আজকে আমাদের মা-বোনদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নাই। তারা নিরাপদ বোধ করেন না এই দেশে। আজকে কোথাও কোনো আইনের শাসন নেই।
“শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী সন্ত্রাসী, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।”
‘আদানির বিদ্যুতে লোকসান দেড় লাখ কোটি টাকা’
ভারতীয় আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ কেনার যে চুক্তি, তার সমালোচনা করে এই হিসাব দেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, “অন্য দেশের চেয়ে দ্বিগুণ দামে আমাদেরকে কয়লা কিনতে হচ্ছে। চুক্তির ফলে বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম দাঁড়াবে প্রায় ১৬ টাকার মত, যেটা এখন ৮ টাকার মত।”
বিদ্যুতের দাম গত দুই মাসে তিনবার বাড়ানোর সমালোচনা করে ফলরুল বলেন, “যদি চুরি বন্ধ করা যেত, তাহলে এতবার দাম বাড়াতে হত না।… কিন্তু তারা বিদ্যুৎ সেক্টরকে বেছে নিয়েছে তাদের টাকা আয় করার জন্য, চুরি করার জন্য।“
‘উন্নয়ন ধুয়ে পানি খাবে মানুষ?’
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়েও কথা বলেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে। কথা দিয়েছিল, তারা ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেবে। মোটা চাল এখন ৭০ টাকা কেজি। পত্রিকায় দেখলাম, মিহি চাল ১৭০ টাকা।
“ডালের দাম বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে। ডিম সাধারণ মানুষের প্রোটিনের উৎস। সেটার দাম তিন-চারগুণ বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে এক লাফে ৬০ টাকা। মানুষ কোথায় যাবে?”
তিনি বলেন, “তাও বাগাড়ম্বর যে এখন নাকি দেশ সবচেয়ে ভালো আছে। তারাই আসলে নাকি সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়। আরে উন্নয়ন ধুয়ে খাবে মানুষ, যদি ভাত খেতে না পারে? আর কোথায় উন্নয়ন? উন্নয়ন হলে তো কর্মসংস্থান থাকত। বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেবে, চাকরি পায়? সরকারি হিসেব মতে প্রায় তিন কোটি বেকার।”
সিলেট বিএনপির নেতৃত্বের লড়াইয়ে যারা
সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকির সভাপতিত্বে ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মিফতাহ সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম এ জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, এনামুল হক চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও।
সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে অধিবেশনে সিলেট মহানগরের ২৭টি ওয়ার্ডের ১ হাজার ৯১৭ জন কাউন্সিলর সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন।
দলের মহানগর শাখার নেতৃত্বে আসতে তিন পদে ৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সভাপতি পদের জন্য লড়ছেন মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি নাসিম হোসাইন ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব মিফতাহ সিদ্দিকী।
সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন আহ্বায়ক কমিটির দুই যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ চৌধুরী শামীম ও এমদাদ হোসেন চৌধুরী।
সাংগঠনিক সম্পাদক পদে লড়ছেন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সৈয়দ সাফেক মাহবুব, সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক রেজাউল করিম নাচন, ৫নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ শফি সাহেদ, মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক ও ২১নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তফা কামাল ফরহাদ।