প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ৮:১২ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ১২, ২০২২, ৫:২৪ পি.এম
মনের জোরে এক পায়ে ভর করেই শুরু করেছিলাম পড়াশোনার হাতেখড়ি। আমার প্রতিবন্ধকতা দেখে পাড়া-প্রতিবেশীরা নানাভাবে আঘাত করতো। অনেকে দেখলেই বলতো, ‘তোর তো এক পা নেই, তোর দিয়ে কিছু হবে না’। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং করতে আসবো তখন আমার পরিবারকে অনেকেই মানা করেছে। বাবাকে সবাই বলতো, বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠালে আমাকে নিয়ে সবাই নিয়ে ঠাট্টা করবে। জীবনে অনেকের অনেক কটু কথা শুনেছি তবুও আমি থেমে থাকিনি। সেগুলোকে পুঁজি করেই আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যায়ন করছি।
কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী ফাহিমা আক্তার খুশি। তার বাম পা অনেকটা ছোট। শুধু ডান পায়ে ভর করে চলাফেরা করতে হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা বাদ দেননি।
খুশি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী। থাকেন মন্নুজান হলে। তিনি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থানার পানিয়াল পুকুরপাড়া গ্রামের ফজলুল হকের মেয়ে।
দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে খুশি সবার ছোট। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি ও কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অনেক প্রতিকূলতা পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত আসতে হয়েছে তাকে।
ফাহিমা আক্তার খুশি বলেন, ‘আমার এক পা ছোট, স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি না। তাই বলে কি আমি স্বপ্ন দেখতে পারবো না? আমিই একদিন দেশের নেতৃত্ব দেবো।’
এক পা দিয়ে বেশি চলাফেরা করলে প্রায় সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন খুশি। তার এ সমস্যার কথা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির বরাবর একটি আবেদন করেছিলেন। তার শারীরিক সমস্যার কথা চিন্তা করে উপাচার্য তার নিজস্ব অর্থায়নে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি বাইসাইকেল কিনে খুশিকে উপহার দিয়েছিলেন।
বাইসাইকেল পেয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেমন যাচ্ছে জানতে চাইলে খুশি বলেন, ‘সাইকেল পেয়ে আমার চলাচল কিছুটা সহজ হয়েছে। যখন সাইকেল ছিল না তখন হেঁটে হেঁটে ক্লাস করতে আমার খুব পরিশ্রম হতো। মাঝে মাঝে পায়ের ব্যথায় শরীরে জ্বর আসতো। পায়ের ব্যথার কারণে রাতে পড়াশোনা ঠিকমতো হতো না। সাইকেল পাওয়ার পর থেকে আমার ক্লাস মিস হচ্ছে না এবং অসুস্থ কম হচ্ছি। সময়মতো ক্লাসে যেতে পারছি। এমনকী সাইকেল চালিয়ে রাতেও লাইব্রেরিতে যেতে পারছি।’
এক পায়ে সাইকেল চালাতে সমস্যা হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে সমস্যা হয়। বিভাগে ক্লাসের চাপ যখন বেশি থাকে তখন সাইকেল চালিয়ে সবগুলো ক্লাস করতে হয়। তখন মাঝে মাঝে পায়ে ব্যথা চলে আসে। ক্যাম্পাসে যেভাবে যানবাহন চলাফেরা করে তাতে ভয়ে থাকি কখন না জানি অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলি।’
খুশির পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। বাবা ফজলুল হকের বয়স হয়ে যাওয়ায় ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। কিছু জমি বর্গা দেওয়া আছে। তা থেকে যা আসে তা দিয়েই কোনোমতে সংসার চলছে। দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। পরিবারের খোঁজ নেন না।
আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক দুই হাজার টাকা বৃত্তি পেতেন খুশি। তবে সেটিও এখন বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে বিভাগের এক বড় ভাই তাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন।
ফাহিমা আক্তার খুশি বলেন, ‘বর্তমানে আর্থিকভাবে খুব কষ্টে আছি। পরিবার থেকে তেমন টাকা-পয়সা দিতে পারছে না। আমি রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় টিউশন খুঁজেও পাচ্ছি না। যখনই একটি টিউশন পাই তখন আমার প্রতিবন্ধকতার কথা জানতে পেরে, না করে দেন। আমার পা ছোট, এটা কি আমার অপরাধ?’
তিনি বলেন, ‘জানি না আমার পরবর্তী ক্যাম্পাস জীবন কীভাবে চলবে। তবে আমি হাল ছাড়বো না। আমি আত্মনির্ভরশীল হতে চাই। আমি প্রতিবন্ধী, কিন্তু সমাজের প্রতিবন্ধী হয়ে থাকতে চাই না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে উচ্চপদস্থ কোনো সরকারি চাকরি করতে চান অদম্য এ মেধাবী।
খুশির বাবা ফজলুল হক বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি। আমার খুশি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার এ সফলতা অন্য প্রতিবন্ধীদের এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা করি।’
লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সপ্নীল রহমান বলেন, সাইকেলটি পাওয়ার পর থেকে সে খুব সহজে ক্লাস এবং বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে পড়ালেখা করতে পারে। এতে তার ক্লাসের পারফরম্যান্স আগের চাইতে অনেক উন্নত হয়েছে। সে যদি সবার থেকে এ ধরনের সহযোগিতা পায় তাহলে সে অনেক ভালো ফলাফল করবে বলে আমি আশাবাদী।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ছাত্র উপদেষ্টার কাছ থেকে খুশির প্রতিবন্ধকতার কথা জানতে পেরে খুশিকে একটি সাইকেল কিনে দেই। এখন বিকেলে হাঁটতে বের হলে যখন খুশিকে সাইকেল চালাতে দেখি তখন নিজের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে। সে পড়াশোনাও ভালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।