‘আজি হতে শতর্বষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে। আজি হতে শতর্বষ পরে।’ এক শ’ বছরেরও বেশি আগে বাঙালি পাঠকদের প্রতি এই জিজ্ঞাসা ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
সেই চিরজাগরুক, বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের নায়ক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ (রোববার, ৮ মে) ১৬১তম জন্মবার্ষিকী।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে এবং ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কালজয়ী এ কবি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ নেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব”, “কবিগুরু” ও “বিশ্বকবি” অভিধায় ভূষিত করা হয়।
১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তার পত্নীবিয়োগ হয়। উইকিপিডিয়া সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
‘হে নূতন/ দেখা দিক আর বার/ জন্মের প্রথম শুভক্ষণ/ তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/ সূর্যের মতন’—নিজ জন্মদিনের এক আয়োজনে এভাবেই নূতনকে আহ্বান জানিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের গান তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তার রচিত “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে” ও “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” গান দুটি যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। মনে করা হয়, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত ‘শ্রীলঙ্কা মাতা’ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা।
তিনি ১৯১৩ সালে তার গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কবির গান-কবিতা, বাণী এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত সাহস যোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শুধু নয়, চিরকালই কবির রচনাসমূহ প্রাণের সঞ্চার করে। আমাদের প্রতিটি সংগ্রামেই শুধু নয়, কবির চিরায়ত রচনাসমগ্র আজীবন স্মরণের শীর্ষতায় আবিষ্ট হয়ে আছে।
নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে নোবেল বিজয়ী এ বাঙালি কবিকে স্মরণ করছে তার অগণিত ভক্তরা। শুধু দুই বাংলার বাঙালিই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলা ভাষাভাষী কবির জন্মবার্ষিকীর দিবসটি পালন করে হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়। এবার জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে-‘মানবতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ।’
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উপলক্ষ্যে পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহের রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে। আজ বেলা আড়াইটায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি এমপি।
স্বাগত বক্তব্য দেবেন সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর। স্মারক বক্তা থাকবেন প্রফেসর সনৎ কুমার সাহা। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনায় নৃত্যনাট্যসহ আধা ঘণ্টার একটি সাংস্কৃতিক পর্ব থাকবে। কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপান উপলক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমি তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনী এবং কবির ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারি মাসব্যাপী প্রচারের ব্যবস্থা করেছে।
এছাড়াও ঢাকাসহ কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
এছাড়াও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করেছে। বাংলা একাডেমিসহ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সকল দফতর ও সংস্থাসমূহ এ উপলক্ষ্যে বিশেষ আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের তত্ত্বাবধানে ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
জন্মের দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে এবং মৃত্যুর অনেক বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ এখনও কেন প্রাসঙ্গিক-এ ব্যাপারে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়াত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, বাঙালির এই কবি এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন, চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর, বাংলাভাষা ছিল অপরিণত।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ একাধারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তা জগতে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। বাঙালির মানস গঠনে পালন করেছেন অগ্রদূতের ভূমিকা। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা যোগানোর মধ্যদিয়ে বাঙালি মননকে বিশ্বমানে উন্নীত করে জাতিকে আবদ্ধ করে গেছেন চিরকৃতজ্ঞতায়। দেড়শত বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে তাই চির জাগরুক হয়ে আছেন।