রোজায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস (ভিডিও)
ডায়াবেটিসের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। এ রোগে ভুক্তভোগীদের সবসময়ই একটা ধরাবাধা নিয়মের মধ্যে চলতে হয়। ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে খাদ্যাভাস ও লাইফস্টাইলের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্যের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীকে অনেক নিয়মকানুন মেনে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
ডায়াবেটিস রোগীদের কঠোর নিয়মকানুন মেনে খাবার ও ওষুধ গ্রহণ করতে হলেও তারাও রোজা রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেকেই হাইপো বা নানারকম সমস্যায় পড়েন।
রোজার সময় দেখা যায়, অনেক ডায়াবেটিস রোগী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারা যেন সঠিক চিকিৎসা পান এবং চিকিৎসকরা যেন তাদের সঠিক চিকিৎসা দিতে পারেন, সে জন্য রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর একটা গাইডলাইন তৈরি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সে বিষয়ের আলোকেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের ড. জোবায়দা নাজনীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন।
ডায়াবেটিস রোগী হিসিবে আপনি যেভাবে রমজানের প্রস্তুতি নেবেন:
ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ:
রমজান মানেই পরিবর্তনের মাস। খাদ্যাভাসের পরিবর্তন, ওষুধের পরিবর্তন। জীবন মানের পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনকে সামঞ্জস্য করতে ও যথাযথ প্রস্তুতি নিতে আপনার ডাক্তার আপনাকে সাহায্য করবে। তাই রমজান শুরুর আগেই আপনার যে ডাক্তার আছেন তার সঙ্গে এক থেকে দুই মাস আগেই যোগাযোগ করুন।
রমজানের পূর্বে আপনার ডায়াবেটিস কত আছে তা পরিমাপ করা উচিত। অতিরিক্ত কম বা বেশি যাই থাকুক তাই রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যা আপনার রোজা রাখায় বাঁধা দিবে। তাই আপনি যদি রমজানের আগেই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেন তাহলে আপনি আপনার খ্যাদাভ্যাস ও ঔষধকে সামঞ্জস্য করে রোজা রাখতে পারবেন।
আপনার ডায়াবেটিসের লেভেল কত? কী কী ওষুধ, কতবার ব্যবহার করছেন? আপনার কিডনি কেমন আছে? আপনার হাইপোগ্লাইসেমিয়ার অভিজ্ঞতা বিগত কয়েকদিনের ভেতরে হয়েছে কি না বা রক্তে আপনার গ্লুকোজ কমে গিয়েছে কি না এ সকল বিষয় যাচাই করে আপনার ডাক্তার আপনাকে রমজানের প্রস্তুতি নিতে দিবেন।
রমজান এসে গেলেই ডাক্তারের কাছ থেকে আমাদের রমজান মাসের জন্য ওষুধ লিখে নিতে হবে। যারা ওষুধ খাচ্ছি এবং যারা ইনসুলিন নিচ্ছি তাদেরকে রমজানে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা
রোজাদারদের ঝুঁকি হাইপোগ্লাইসিমিয়া আর হাইপারগ্লাইসিমিয়া। রক্তে চিনির মাত্রা খুব কমে গেলে অনেক সময় মানুষ অচেতন বা অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারেন, যাকে বলা হয় হাইপো বা হাইপোগ্লাইসিমিয়া। আবার রক্তে চিনির মাত্রা খুব বেশি হয়ে গেলে হাইপারগ্লাইসিমিয়া হতে পারে। তখন অবসান, মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি ইত্যাদি সমস্যার তৈরি হতে পারে। এ কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে চিনির মাত্রা সবসময় নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।
ঔষধ ও খাদ্যের সমন্বয়
ডায়াবেটিস রোগীদের বিকেল বেলায় রক্তের গ্লুকোজ কমে যাওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে। আবার অনেকের হাইপো হতে পারে, এমন আশঙ্কায় ওষুধ না খেলে বা কম খেলেও সমস্যার তৈরি করতে পারে। ফলে তাদের ওষুধের সমন্বয় ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
গরমে ডায়াবেটিস রোগীর যত্ন
খাবারের সময় পরিবর্তন
সাধারণভাবে আমরা সেহরিকে সকাল ভাবি। অথবা সকালে আমরা বেশি ইনসুলিন বা ওষুধ খেয়ে থাকি। কিন্তু রমজানে সেহরিকে সকাল ভাবা যাবে না। সেহরিকে সকাল ভেবে ওষুধ খেলে মারাত্মক বিপদ হতে পারে। রমজানে ইফতারকে সকাল ভেবে ওষুধ খেতে হবে। মানে সকালে যে ডোজ আমরা খেতাম সেটা রমজানে ইফতারের সময় খেতে হবে। আর রাতেরটা খেতে হবে সেহরিতে।
যাদের সকালে নাস্তার আগে বা পরে ডায়াবেটিসের ওষুধ খেতে হতো, সেটি তারা ইফতারের সময় খাবেন। আর রাতের ওষুধ খাবেন সকালে সেহরির সময়। দুপুরের ওষুধ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে সমন্বয় করে নিতে হবে।
ইফতারে কী খাবেন?
ইফতারে কি খাবেন, কতটুকু খাবেন তাও আপনার ডাক্তার আপনাকে পরামর্শ দিবেন। এমনকি আপনি রোজা রাখায় সক্ষম কি না তাও আপনার ডাক্তার আপনাকে জানাতে পারবেন।
ইফতারে ডায়াবেটিস রোগীদের ভালোভাবে নজর দিতে হবে। চিনি, গুড় ও মিষ্টি জাতীয় শরবত বাদ দিতে হবে। অতিরিক্ত টক জাতীয় ফল ও অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় ফলের শরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা, দুটোই আপনার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।
ইফতারে আপনি আপনার ডায়াবেটিস এর বই অনুসরণ করতে পারেন। সেখানেই ফলের ছবি ও পরিমাণ দেওয়া আছে। বইয়ে দেওয়া ফলই ওই পরিমাণ আস্ত বা শরবত করে খেতে পারেন।
সেহরিতে কী খাবেন?
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সেহরি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেহরিতে প্রোটিনযুক্ত খাবার দুধ, ডিম, মাছ, মুরগি অবশ্যই খাবেন। তবে সেটা পরিমাণমতো। ভুলেও সেহরি না খেয়ে কিংবা কম খেয়ে ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখবেন না।
রমজানে ডায়াবেটিস পরীক্ষা কখন করবেন?
ইফতারের দুই ঘণ্টা পর ভরা পেটে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করলে সাধারণত ৭ থেকে ১০ এর ভেতরে থাকবে। প্রতিদিন বা একদিন পর পর ইফতারের দুই ঘণ্টা পর ভরা পেটে এই পরীক্ষাটি করবেন। ঠিক একইভাবে ইফতারের দুই ঘণ্টা আগেও খালি পেটে পরীক্ষা করবেন। আরেকবার পরীক্ষা করবেন রোজা রাখার পর সকাল ১০টা থেকে ১২ টার ভেতরে। কয়েকদিনের পরীক্ষার ফলাফলের চার্ট নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। পরবর্তী করণীয় ডাক্তার বলে দিবেন।
ইফতারের দুই ঘণ্টা পরে, রোজা রেখে সকাল ১০টা থেকে ১২টার ভেতরে এবং ইফতারের আগে আমরা একবার করে ডায়াবেটিস মেপে নেওয়ার চেষ্টা করবো।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস রোগীর সেহরি ও ইফতার
ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও ইনসুলিন নিলে রোজা নষ্ট হবে কি না
এখন কথা হলো, রোজা রেখে এই রক্ত পরীক্ষা করলে রোজা হবে কি না! রমজানে নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করলে রোজায় কোনো সমস্যা হয় না।
এই বিষয়ে শুধু ডাক্তাররা নন, সমগ্র বিশ্বের আলেমগণের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, গ্লুকোমিটারে রক্ত পরীক্ষা করলে তাতে রক্ত ঝরঝরিয়ে গড়িয়ে পড়ে না। যার ফলে রোজা ভাঙ্বে না। ডায়াবেটিস পরীক্ষায় চিকিৎসার জন্য আমরা মাত্র কয়েক ফোটা রক্ত ব্যবহার করছি যাতে রোজা ভাঙ্গবে না বরং রোজাটাকে সফলভাবে রাখতে সাহায্য করবে।
ঠিক একইভাবে আমরা বলতে পারি, আমরা যখন ইফতারের আগে ইনসুলিন নেওয়ার কথা বলছি। তখন রোজা নষ্ট হবে কি না। ইনসুলিন কোনো খাদ্য বা পুষ্টি নয়। তাই ইনসুলিনের ক্ষেত্রেও রোজা নষ্ট হবে না। যা আলেমগণদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এভাবেই আমরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে রোজা রাখতে পারব। সুস্থ ও নিরাপদ থাকব।