দিন দিন কমছে পণ্যের আমদানি। এতদিন এর বড় কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট। সে সমস্যা প্রায় দেড় বছরের। এর সঙ্গে নতুন সংকট যুক্ত হয়েছে পণ্যের আমদানিতে। লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে একের পরে এক হামলা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে চলাচলকারী জাহাজগুলো আসতে হচ্ছে ভিন্ন রুট ঘুরে। এতে যেমন পণ্য আমদানিতে সময় বেশি লাগছে, তেমনি খরচও বাড়ছে। একই ধরনের সমস্যা হচ্ছে তৈরি পোশাকসহ অন্য পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও।
আমদানি-রপ্তানিকারক একাধিক প্রতিষ্ঠান বলছে, চলমান সংকটে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। সময় বেশি লাগছে ১০ থেকে ১২ দিন। পর্যায়ক্রমে এ খরচ আরও বাড়বে বলে শঙ্কা ব্যবসায়ীদের। একই সঙ্গে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, শিগগির এ সমস্যা সমাধান না হলে প্রভাব পড়বে রমজানের পণ্য আমদানিতে। অন্যদিকে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতেও।
হুথিদের একের পর এক জাহাজে হামলার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে বিশ্বের বড় বড় জাহাজ কোম্পানি পরিহার করছে এ পথ। এতেই বিপত্তি ঘটছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। ভিন্ন পথে খরচ যেমন বাড়ছে, তেমন সময়ও লাগছে বেশি
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোহিত সাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যকার ১২০ মাইল দীর্ঘ সুয়েজ খাল আফ্রিকাকে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া থেকে পৃথক করেছে। এটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট পথ। এ পথ দিয়ে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, শস্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ ও কনটেইনার ট্রাফিকের প্রায় ৩০ শতাংশই যায় এ পথে।
তাই হুথিদের একের পর এক জাহাজে হামলার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে বিশ্বের বড় বড় জাহাজ কোম্পানি পরিহার করছে এ পথ। এতেই বিপত্তি ঘটছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। ভিন্ন পথে খরচ যেমন বাড়ছে, তেমন সময়ও লাগছে বেশি।
এ বিষয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, লোহিত সাগর হয়ে রাশিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া, তুরস্ক, বুলগেরিয়া থেকে পণ্য আনতে সমস্যা হচ্ছে। আলাদা খরচ লাগছে।
তিনি বলেন, বিকল্প রুটে জাহাজ চলাচলের কারণে বিমা ও জ্বালানি খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে শিপিং কোম্পানিগুলো কনটেইনার ও জাহাজে পণ্য পরিবহনের চার্জ বাড়িয়েছে। সমস্যা সমাধানের কোনো আশা এখনো দেখা যাচ্ছে না। শিপিং কোম্পানিগুলো আমাদের অপেক্ষা করতে বলছে।
আবুল বশর চৌধুরী বলেন, এ সংকট যত দিন চলবে, জাহাজ পরিবহন বিঘ্নিত হবে। ভাড়াও বাড়বে বলে শঙ্কা করছি।
এদিকে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মো. রিয়াজ উদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, এখন ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে প্রতি কনটেইনারের ভাড়া এক থেকে দেড় হাজার ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। এ পথে সময় বেশি লাগছে ১০ থেকে ১২ দিন।
বৈশ্বিক জাহাজভাড়ার শীর্ষস্থানীয় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ক্লার্ক সন্স-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এশিয়া থেকে উত্তর ইউরোপগামী ৪০ ফুটের একটি কনটেইনারের ভাড়া ৪ হাজার ডলার বেড়েছে এ হামলা শুরুর পরে। শেষ এক সপ্তাহে চীনের সাংহাই থেকে ইউরোপ পথে প্রতি ২০ ফুট আকৃতির কনটেইনারের ভাড়া আগের তুলনায় ৮ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ১০৩ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের পথ এ সংঘাতের কারণে আক্রান্ত না হলেও এ পথে ৪০ ফুট আকৃতির কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ৯৭৪ ডলারে উঠেছে অন্য পথে চাপ বৃদ্ধির কারণে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর হামলায় হুথি বিদ্রোহীরা এখন নিয়ন্ত্রণে এলেও এ পথে জাহাজ চলাচল একদম স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে আরও অন্তত দুই মাস লেগে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে জাহাজগুলো চলছে। এতে পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত সময় লাগার পাশাপাশি আসা-যাওয়ায় গড়ে প্রায় ২০ লাখ ডলারের অতিরিক্ত তেল লাগছে।
এসব কারণে বাংলাদেশে এরই মধ্যে আমদানিকারকরা অভিযোগ করতে শুরু করেছেন, এখন পণ্য আনতে দেরি হচ্ছে, যা সরবরাহ পরিস্থিতিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
এ রুটে সমস্যার কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে গার্মেন্টস ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বেশি সময় এ সমস্যা থাকলে এ খাতে নতুন সংকট তৈরি করবে।
দেশের অন্যতম পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, এখন অনেক ফ্রেইট (জাহাজ ভাড়া) বেড়েছে। এ কারণে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বেশি দিচ্ছি আমরা। আগে প্রতি টন পণ্যে ৫০ ডলার ভাড়া ছিল, এখন ৭০ থেকে ৭৫ ডলার পর্যন্ত হয়েছে।
পণ্য রপ্তানিতেও সমস্যা
আমদানির মতো ইউরোপের কোনো দেশে পণ্য রপ্তানি করতে গেলেও লোহিত সাগরের ওই পথ ব্যবহার করতেন রপ্তানিকারকরা। ইউরোপ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। ফলে এখন তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতেও খরচ বেড়েছে। লাগছে বেশি সময়।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম বলেন, এ নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ রুটে সমস্যার কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে গার্মেন্টস ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বেশি সময় এ সমস্যা থাকলে এ খাতে নতুন সংকট তৈরি করবে।
বাংলাদেশ এগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক বলেন, এ পরিস্থিতিতে প্রক্রিয়াকরণ খাদ্যের রপ্তানি কমে গেছে। বিশেষ করে পণ্য পাঠানোর খরচ আরও বেশি হারে বেড়েছে। অনেক রপ্তানিকারক চারগুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া দিয়েছেন। এতে পণ্য রপ্তানি করে লাভ করা যাচ্ছে না। আবার সময় মতো পণ্যও পৌঁছানো যাচ্ছে না।
পণ্য আমদানি কমেছে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) নিত্যপণ্যের মধ্যে ডাল, চিনি, সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে গড়ে ৩০ শতাংশ কমেছে।
এসময়ের ব্যবধানে অন্য বছরের তুলনায় গম, মসুরসহ অন্যান্য ডাল, চিনি, তেল, খেজুর ফলসহ বেশকিছু পণ্যের আমদানিও কমেছে।