সব দলের অংশ নেবে কিনা, এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ ধরে হাঁটছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশ নেবে না-এমনটা ধরে নিয়েই ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি। নির্বাচনী সামগ্রী কেনা, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত ও প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় কার্যক্রম চলছে পুরোদমে।
ইসির কেন্দ্রীয় ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে। অবশ্য সব দল না এলে নির্বাচন কতটা সংঘাতহীন রাখা ‘সম্ভব’ হবে- সেই শঙ্কাও রয়েছে ইসির মধ্যে। যদিও এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির দাবি, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তারা সাংবিধানিক ক্ষমতার পুরোটাই প্রয়োগ করবে। সুষ্ঠু ভোটে তারা সরকার ও রাজনৈতিক দলের সহযোগিতাও কামনা করেছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাসের মাথায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে ঘোষিত রোডম্যাপের বেশিরভাগ কাজ গুছিয়ে এনেছে। অবশ্য সব দলের আস্থা অর্জনের যে বিষয়টি ইসির রোডম্যাপে ছিল তা দৃশ্যত এখনও সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী দেড়শ’র মতো আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার কথা থাকলেও আর্থিক সংকটে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরে পুরোটাই ব্যালটে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
প্রস্তুত হচ্ছে ভোটের সরঞ্জাম
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনি কাজের জন্য বেশ কয়েক ধরনের সরঞ্জাম দরকার হয়। এরমধ্যে ব্যালট পেপার, স্ট্যাম্প প্যাড, গালা, মনোনয়ন ফরম, অফিসিয়াল সিল (গোল সিল), মার্কিং সিল (ব্যালটে মারার সিল), ব্রাশ সিল (সিলগালা করার জন্য পিতলের সিলমোহর), অমোচনীয় কালির কলম, ছোট-বড় দুই ধরনের চটের ব্যাগ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও বাক্সের লক ইত্যাদি। এছাড়াও একাধিক রঙের কলম, খামসহ আরও কিছু সামগ্রী প্রয়োজন পড়ে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটার কাজও শেষ পর্যায়ে। এ মাসের মধ্যেই শতভাগ কেনাকাটা সম্পন্ন হবে। এসব সামগ্রীর মধ্যে প্রায় সবগুলোরই দরপত্র ও কার্যাদেশ আগেই সম্পন্ন হয়েছে। বেশ কিছু সামগ্রী ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অমোচনীয় কালির কলম কেনা নিয়ে কিছুটা জটিলতা হলেও গত সপ্তাহে সেটার চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের জন্য ৮০ হাজার ব্যালট বাক্স কেনা হচ্ছে। ব্যালট বাক্স ও ঢাকনা আগে বিদেশ থেকে আমদানি হতো। তবে এবার দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই এগুলো কিনছে ইসি। অন্যদিকে সরকারি মুদ্রণ সংস্থার ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ৬১ হাজার রিম বা ৩২ লাখ ২০ হাজার দিস্তা কাগজ কেনা হচ্ছে। এ কাগজ দিয়ে তৈরি হবে ব্যালট পেপার, বিভিন্ন ধরনের খাম ও প্যাড। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময় শেষ হলেই ব্যালট পেপার ছাপানোর কাজ শুরু হবে।
প্রশিক্ষণ চলছে
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে নির্বাচনি প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর এই প্রশিক্ষকরা নির্বাচনি কর্মকর্তাদের (প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার) প্রশিক্ষণ দেবে। এছাড়া প্রশিক্ষণ চলছে নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে নির্ধারিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা-উপজেলা নির্বাচনি কর্মকর্তাদের। আজ শনিবার শুরু হচ্ছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণ।
তফসিল নভেম্বরে
রোডম্যাপের ঘোষণা অনুযায়ী নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তফসিল ও ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতে হবে ভোটগ্রহণ। অবশ্য ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট করবে এমন তথ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।
জানা গেছে, জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তফসিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভোটের তফসিলের ব্যাপারে অবহিত করবে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন।
রাজনৈতিক সমঝোতার অপেক্ষা
ভোটের পুরো প্রস্তুতি ইসির থাকলেও এখনও তারা অপেক্ষা করছে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের জন্য। ইসি প্রত্যাশা করছে, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে তারা ভোটে ফিরবে। তবে সর্বশেষ কোনও সমঝোতা না হলে সংবিধান অনুযায়ী ভোটের পথে হাঁটবে তারা। সেক্ষেত্রে কোনও দল নির্বাচনে না এলেও তাদের কোনও কিছু করার থাকবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্য কমিশনাররা এরইমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ হিসাবে চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিন অর্থাৎ, ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে ১ নভেম্বর শুরু হচ্ছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা।
অবশ্য, বিএনপি বা তার মিত্রকে ছাড়া ইসিকে শেষ পর্যন্ত ভোটে যেতে হলেও বিষয়টিতে নিজেদের জন্য স্বস্তিদায়ক মনে করছেন না সিইসি নিজেই। এদিকে সব দল অংশ না নিলে নির্বাচনে গোলযোগ হতে পারে, ইসি এমন বার্তাও পেয়েছে তার মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের থেকে।
গত ৮ অক্টোবর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সভায় ইসির মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মাঠ কার্যালয়গুলো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। এজন্য তারা তাদের কার্যালয় সুরক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ করেন।
বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি সম্পর্কে সিইসি বলেছেন, তারা নির্বাচনে না এলে নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অন্য ৫-১০টা দল অংশ নিলেও তারা ‘মূল বিরোধী দল’ যে বিএনপি, তাদের সমকক্ষ ওরা নয়। ওই দলটা যদি অংশগ্রহণ না করে তাহলে একটা অনিশ্চয়তা বা একটা শঙ্কা, একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যেতে পারে এতে কোনও সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, নির্বাচন যদি কোনও সংঘাত বা সহিংসতা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে তারা ‘খুশি হবেন’ বটে, কিন্তু গণতান্ত্রিক চেতনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্বাচন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনে কোনও ধরনের রদবদলের পরিকল্পনা ইসির নেই জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, প্রশাসনে রদবদল করলেই যে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে সে নিশ্চয়তা নেই। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর বিরোধী দল যদি প্রশাসনে রদবদলের কথা বলে তাহলে সেটি বিবেচনা করবে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, সংবিধান এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন। আরপিওতে যেভাবে নির্দেশনা রয়েছে, সেভাবে আমরা সোজা এগিয়ে যাচ্ছি। ডানে বামে তেমন তাকাচ্ছি না। আমাদের প্রস্তুতি আপ টু-ডেট আছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশন প্রস্তুত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ হয়েছে। আইনি কাঠামোর সংস্কারও হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসের শেষ দিকে তারা নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার সংশোধনী চূড়ান্ত করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। যদিও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনীতে ইসির ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১০৩টি। আর ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১৪টিতে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে।
নির্বাচনের খরচ
ইসি সূত্র জানায়, ৯ লাখের বেশি নির্বাচনি কর্মকর্তাসহ নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, নির্বাচনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাতা মিলিয়ে এবার প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এর বাইরে নির্বাচনি প্রশিক্ষণে খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি।
এদিকে, প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলে ভয়ভীতি ও বাধা প্রদান ঠেকাতে এবার অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে জামানতের টাকা পরিশোধেরও সুযোগ থাকছে।
অন্যদিকে, ভোটকেন্দ্রের নাম ও ভোটার নম্বর খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি কমাতে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে কমিশন। এই অ্যাপে ভোটারের তথ্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, ডিসি, এসপি, ওসিসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পরিচয়, ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে।
ভোটের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। সার্বিক কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোচ্ছে। এরইমধ্যে নির্বাচনি উপকরণ আসা শুরু হয়েছে। সব নির্বাচনি সামগ্রী সময়মতো পেয়ে যাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।