সন্ধ্যা নামলেই রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনজুড়ে তৎপরতা বাড়তো অপরাধীদের। মাদকসেবী ও কারবারিদের দখলে চলে যেত পুরো এলাকা। ছিঁচকে চুরি আর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতো অহরহ। স্টেশন ও প্ল্যাটফর্ম এলাকায় অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজশাহী রেলওয়ে থানা পুলিশ।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ২ মার্চ দিবাগত রাতে যাত্রীবেসে একদল যুবক ঢুকে পড়ে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় ট্রেনের তিনটি কোচ। ওই আগুনে রেলের ক্ষতি হয় প্রায় ৩ কোটি টাকা।
সময় যতই গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। পুলিশ বলছে, সবার আগে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি সম্পদ রক্ষার দায়-দায়িত্বও তাদের কাঁধে। এখন রাজনৈতিক নাশকতার শঙ্কা না থাকলেও সার্বিক বিষয় মাথায় রেখেই নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজাচ্ছে রেলওয়ে পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে স্টেশন এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে।
জানা যায়, রেলওয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনের গেট দিয়ে সাধারণ মানুষের বেশে স্টেশন এলাকায় ঢুকতেন অপরাধীরা। অপকর্ম ঘটিয়ে সার গুদামের পূর্ব পাশের পকেট গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতেন তারা। থানার সামনে দিয়েও অনায়াসে ঢুকে পড়তেন ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। অপকর্ম করে এই পথ দিয়ে চলে যেতেন নির্বিঘ্নে। তবে স্টেশনে আসা-যাওয়ার এসব ফটকে এখন তালা ঝুলছে। এখন আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে প্রধান ফটক দিয়ে।
রাজশাহী রেলওয়ে থানা পুলিশ জানিয়েছে, স্টেশনে অপরাধ নির্মূলেও খগড়হস্ত রেলওয়ে পুলিশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ আগস্ট থেকে স্টেশনজুড়ে চিরুনি অভিযান চলেছে বেশ কয়েকবার। গ্রেপ্তার হয়েছেন
২০ জন। চুরি, দস্যুতার চেষ্টা, মাদকসেবন ও বিক্রি, টিকিট কালোবাজারি, বিনা টিকটে ভ্রমণকারীসহ নানা অপকর্মে ৭টি মামলাও হয়েছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে একজনকে। সবমিলিয়ে আদায় হয়েছে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা।
পুলিশের ভাষ্য, তাদের কঠোর অবস্থানের কারণে এখন অপরাধীরা এলাকাছাড়া। কিন্তু স্টেশনে ঢুকতে তারা মরিয়া। গত ২৮ অক্টোবর বেলা আড়াইটার দিকে দলবল নিয়ে থানায় চড়াও হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন রাজা। অপরাধীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বন্ধ দরজাগুলো খুলে দেওয়ারও দাবি জানান তিনি। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি পুলিশ। ওই দিন বিকেলে পশ্চিম রেলের জেনারেল ম্যানেজারসহ পদস্থ কর্মকর্তারা সেখানে যান। তারা অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পুলিশকে আরও কঠোর হওয়ার তাগিদ দেন।
পুলিশ বলছে, রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন বাস্তুহারা এলাকার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে আনোয়ার হোসেন রাজার বিরুদ্ধে স্টেশন এলাকার অপরাধচক্র নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। রেলে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর রেলভবন এলাকায় ছুরিকাঘাতের শিকার হন তিনি। ওই ঘটনায় তার ছোটো ভাই ফয়সাল হোসেন রাসেল প্রাণ হারান। তবে অভিযোগ বিষয়ে আনোয়ার হোসেন রাজার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোপাল কুমার জানান, যাত্রীসাধারণের নিরাপদ ভ্রমণ ও স্টেশন এলাকায় থাকা অপেক্ষমাণ ট্রেনের র্যাকের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। স্টেশন প্ল্যাটফর্ম এলাকায় মাদকসেবীদের উৎখাত করা হয়েছে।
ওসি আরও বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণসহ যাত্রী ব্যতীত স্টেশন প্ল্যাটফর্মে হকার, ভিক্ষুকসহ ভাসমান লোকের চলাচল নিয়ন্ত্রণেও কঠোর পুলিশ। আর তাতেই অপরাধীদের প্রশয়দাতারা পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত। এদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রতিদিন রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর, বিরতিহীন, কমিউটার ও মালবাহীসহ ৪০টি ট্রেন চলাচল করে। রাজশাহী থেকে হাজারো যাত্রী পাড়ি দেন দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে।
পাকশী রেলওয়ে পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দিন জানান, দেশের যে কটি রি-মডেলিং স্টেশন আছে তার মধ্যে রাজশাহী একটি। এসব রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ এবং বের হওয়ার ফটক একটিই। ফলে থানার ভেতর দিয়ে লোকজনের চলাচলের সুযোগ নেই। এতে রেলওয়ে স্টেশন এবং থানার নিরাপত্তা বিঘিœত হয়।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, যারা থানায় চড়াও হয়েছিলেন, তারা রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে থাকা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। দীর্ঘ দিন ধরেই চক্রটি সক্রিয়। অপরাধ নির্মূলে পুলিশ এই চক্র ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর। এ সময় স্টেশনে রাজনৈতিক নাশকতার শঙ্কা কিংবা নাশকতার ঘটনা ঘটানোর পরিস্থিতি নেই।