শনিবার সকালে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে মওয়ায় আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক রঞ্জিত হয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্ত ধারায়। কিন্তু বাঙালি আবার সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।”
উৎসবের এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যার অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই, এ দেশের মানুষের ভাগ্য পবির্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।”
দেশের সব থেকে বড় সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে শনিবার সকাল ১০টায় মাওয়ায় আয়োজিত সুধী সমাবেশের মঞ্চে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের ঐতিহাসিক এই মুহূর্তকে দেশের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেন তিনি।
দেশের মানুষকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের সমর্থন আর সাহসেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করা সম্ভব হয়েছে।
“আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। সেই সঙ্গে আমিও আনন্দিত এবং গর্বিত, উদ্বেলিত।”
বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা মাথা নোয়াইনি। আমরা কখনও মাথা নেয়াব না। জাতির পিতা শেখ মুজিব কখনও মাথা নোয়াননি, মাথা নোয়াতে শেখান নাই। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন।”
অনেক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ সম্ভব হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, “সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।
“বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ ‘দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, আমরা বিজয়ী হয়েছি,” বলেন তিনি।
সরকার প্রধান বলেন, “এই সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এই সেতু দুই পাড়ের যে বন্ধন সৃষ্টি করেছে তা নয়, এই সেতু শুধু ইট, সিমেন্ট, স্টিল, লোহা, কংক্রিটের একটা অবকাঠামো নয়, এই সেতু আমাদের অহংকার, এই সেতু আমাদের গর্ব। এই সেতু আমাদের সক্ষমতা, আমাদের মর্যাদার শক্তি।
“এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয় যে আমরা এই সেতু তৈরি করবই। সেই জেদ, সেই প্রত্যয়।”
পদ্মা সেতু প্রকল্পে অনেক বাধা আসার কথা তুলে ধরে প্রধামন্ত্রী বলেন, “আপনারা সবাই জানেন, এ সেতু নির্মাণ করতে যখন আমরা যাই, অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হয়, মিথ্যা অপবাদ, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবারকে যে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে; আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আমার মেয়ে সায়মা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলাম ড. মসিউর রহমানকে, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া…যারা এর সাথে জড়িত ছিল, তাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়, তাদের পরিবারসহ যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমি তাদের প্রতি সহমর্মিমতা জানাই।”
শেখ হাসিনা বলেন, “ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণ করতে প্রায় দুই বছর দেরি হয়। আমরা কখনও হতোদ্যম হইনি। হতাশায় ভুগিনি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছি এবং শেষ পর্যন্ত সকল অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি।
“আজকে পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি রঙের আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।”
প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশি-বিদেশি পরামর্শক, ঠিকাদার, প্রযুক্তবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
‘শুভ বুদ্ধির উদয় হোক’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরু থেকে যারা নানা সময়ে বাধা সৃষ্টি করেছেন তাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।”
পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সরে যাওয়া, প্রকল্পে যুক্ত কর্মকর্তাদের নামে মামলা এবং বাংলাদেশের কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধির ওই সময়ের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০০১ সালের ৪ জুলাই তিনি মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
“২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার ২২ দিনের মধ্যে আমরা নকশা তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকও এগিয়ে আসে। কিন্তু দেশের কোনো একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির জন্য বিশ্ব ব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে যায়।
“এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। আমাদের দেশের কোনো এক স্বনামধন্য ব্যক্তি… তিনি কোনো একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। আইনগতভাবে এমডির পদে থাকতে পারেন ৬০ বছর পর্যন্ত, কিন্তু তিনি ৭০ বছর বয়স হয়ে গেলেও এমডি পদে বহাল থাকেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে ওই ব্যাংকের অ্যাডভাইজার এমিরেটাস পদে থাকার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তিনি ক্ষেপে যান। সরকারের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বিরুদ্ধে, অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেও হেরে যান।
“এরপর আমরা দেখলাম বিশ্ব ব্যাংক আমাদের অর্থ বন্ধ করে দিল দুর্নীতির অভিযোগ এনে। বিষয়টি নিয়ে অনেক পানি ঘোলা করা হয়েছে, অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকজন অর্থনীতিবিদসহ কয়েকজন।”
সরকার প্রধান বলেন, “অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক জ্ঞানীগুণী তাদেরও নানা রকমের মতামত। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, সত্যিই বুঝি দুর্নীতি হয়েছে। যেখানে কোনো টাকা পয়সাই ছাড় হয়নি। কানাডার আদালত যখন রায় দিল তখন তারা থেমে যান।”
যারা বলেছিলেন, পদ্মা সেতু একটি স্বপ্ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা সম্ভব না, তাদের বিরুদ্ধে তার ‘কোনো অভিযোগ নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমার কোনো অনুযোগ নাই। তাদের হয়তো চিন্তার দৈনতা আছে, আত্মবিশ্বাসের দৈন্যতা আছে বলে আমি মনে করি। আজ থেকে আমি মনে করি, আজ থেকে তাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে যে বাংলাদেশ পারে।
“আমি আশা করি, সেতুর কাজ বন্ধ করতে যারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করেছে বা বাধা দিয়েছে, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তাদের হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। দেশের মানুষের প্রতি তারা আরও দায়িত্ববান হবে।”
পদ্মাসেতুর দুই পাড়ের মানুষ, যারা নির্দ্বিধায় তাদের জমি হস্তান্তর করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “তাদের ও তাদের পরিবারকেও আমরা পুনর্বাসন করেছি। কিন্তু যারা নিজের জায়গা ছেড়ে চলে যায়, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যে, তাদের ত্যাগ ও সহযোগিতা না হলে হয়ত এ সেতু নির্মাণ করা কঠিন হত।”
পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ সেতু নির্মাণকালীন যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, সেতুর উদ্বোধনের ক্ষণে তাদেরও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছিলেন