ঢাকা ০২:৪৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজ ফাইনাল

ফজলি আম নিয়ে চাঁপাই- রাজশাহীর যুদ্ধ

ফাইল ছবি

ফজলি আম কার তা নির্ধারণ হবে আজ মঙ্গলবার। এই আমের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৃথকভাবে দাবি করেছে। যার শুনানী আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে। এর পর জানা যাবে ফজলি আম রাজশাহীর না চাঁপাইনবাবগঞ্জের।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের শুরু দিকে বাঘার ফজলি আম রাজশাহীর জিআই পন্য হিসেবে স্বীকৃতি জন্য আবেদন করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ প্রয়োজনীয় তথ্য যুক্ত করে এ আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই বাছাই শেষে সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় গত বছরের ৬ অক্টোবর বাঘার ফজলি আমকে রাজশাহীর নিজস্ব পণ্য হিসেব স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর।
তবে ফজলি আম নিজেদের অঞ্চলের দাবি করে এই সিদ্ধান্তের উপর নারাজি দেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এ্যাসোসিয়েশন। আর এতেই জিআই সনদ আটকে যায় রাজশাহীর ফজলি আমের। আগামীকাল ২৪ মে মঙ্গলবার শুনানির মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিস্পত্তি করতে চায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আখতারুল ইসলাম বলেন, ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাচীনতম ফল ফজলি আম উৎপাদন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। দেশ বিভাগের আগে এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছিল মালদা জেলার অন্তর্গত।
ফজলি আম নিয়ে আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দীর্ঘ ইতিহাস। তিনি আরো বলেন,
ফজলি আম, ভৌগলিক নিদর্শন চাঁ,নবাবগঞ্জের নাকি রাজশাহীর,সমাধান আজ। তিনি আসবাদ ব্যক্ত করেন , চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলে আম জিআই পন‌্য হিসাবে স্বীকৃতি পাবে।
তিনি ফজলি আমের পুরাতন ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন ,চাঁপাইনবাবগঞ্জ পূর্বে মালদা জেলার অংশ হিসেবে আড়াই হাজার বছরের আমচাষ ও বিপণনের ঐতিহ্য বহন করে। সে সময় থেকে বর্তমানেও বড় বড় আমবাগান, এমন কী একক ব্যক্তিমালিকানায় একশ’-দেড়শ’ বিঘার বাগান এখনো বিদ্যমান। দেশ বিভাগের আগে ও পরে মধ্য আষাঢ়ের পর বারঘরিয়া, কানসাট, রহনপুর, ভোলাহাট থেকে নদীপথে ৪০০-৫০০ মণ আমভর্তি প্রচুর নৌকা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে বাজারজাত করার জন্য ঢাকুয়ালরা (ঢাকার আম ব্যবসায়ী) ছুটে আসত। তার আগে নৌকায় কলকাতায় নেয়া হতো। বর্তমানে উন্নত সড়ক অবকাঠামোর সুবাদে বাগান বা আড়ৎ থেকে ট্রাকযোগে আম দেশের অধিকাংশ জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে। দেশের বৃহত্তম আমের বাজার বা ব্যবসা কেন্দ্র হচ্ছে কানসাট, যেখানে মৌসুমে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ আম কেনাবেচা হয়।
ফলে দেশভাগ এবং স্বাধীনতার পর এককভাবে আম উৎপাদন ও বিপণনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।
দেশভাগের পূর্ব থেকে রাজশাহী পুরোনো জেলা হলেও এই জেলায় আমচাষের প্রচলন সেভাবে ছিল না। যৎসামান্য চাষাবাদ হলেও খ্যাতি লাভ করেনি। সমসাময়িক কালে সেখানে আমের চাষাবাদ বাড়লেও ফজলি বাগান ও উৎপাদন সেভাবে বাড়েনি, সাম্প্রতিককালে সেখানে উৎপাদন সব ধরনের আমসহ কমবেশি ৪০ হাজার টন। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শত বছরেরও অধিক ফজলি আমের বাগানের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান এবং মোট উৎপাদনের প্রায় ১৭%। দেশের পূর্বাঞ্চলের অনেক জেলায় ফজলি মালদহি আম হিসেবে বয়স্কদের নিকট পরিচিত।
সুইডেন প্রবাসী ও ব্যবসায়ী বদরুদৌজা নাচোলের লোক। তিনি ২০১৩ সালে নাচোলের এক বাগান থেকে সুইডেনের মতো পশ্চিমা দেশে সর্বপ্রথম মানসম্মত উপায়ে সীমিত পরিমাণে আম রপ্তানি করেন। পরের বছর থেকে ইউরোপের বৃহত্তর বাজারে দেশ থেকে রপ্তানি শুরু হয় এবং মাঝে একাধিক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়।
২০১৭ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হঠকারী সিদ্ধান্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ অঞ্চলের আম রপ্তানি থেকে বঞ্চিত করা হয়। সে সময় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো আম রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। মেহেরপুর নিবাসী এক কোয়ারেন্টাইন কর্মকর্তা সে জেলার রপ্তানিযোগ্য আম গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হবার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ঘোষণা করে দেশে কোনো রপ্তানিযোগ্য আম নেই। ফলে সে বছরে এতদঞ্চলের ৮ কোটি আম রপ্তানি করতে ব্যর্থ হয়।
মাত্র ৩০ হাজার টন উৎপাদন সক্ষম সাতক্ষীরা জেলার ব্যবসায়ীরা স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অসাধু পন্থা যথা আঁটি পোক্ত না হওয়া সত্ত্বেও কৃত্রিম উপায়ে আমের রঙ হলুদ করে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করে। এ ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের মে মাসের মাঝামাঝির পর। এখানেও ছলনার আশ্রয় নেয়া হয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর আম হিসেবে এগুলো রপ্তানি করা হয়েছিল।
রপ্তানিকৃত সমস্ত আম ফেরত আসে এবং আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে আম রপ্তানি। এ সময় দেশের বিভিন্ন জেলায় ৮ কোটি আম রপ্তানির উদ্দেশ্যে পরিচর্যা করা হয়, এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই ছিল সাড়ে ছয় কোটি। দেশের সব ধরনের গণমাধ্যম সাতক্ষীরার আম ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট কৃষি দপ্তর কর্মকর্তাদের অপকর্মের কার্যকলাপ প্রধান শিরোনাম হয় ও সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে ওঠে।
দেশভাগ রাজশাহীর জন্য শাপে বর হয় এবং কপাল পুড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার। শিবগঞ্জ-ভোলাহাটের আম রাতারাতি রাজশাহীর আম নামে দেশে পরিচিতি লাভ করে, সে ধারা আজও আংশিক বিদ্যমান।
 উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্বীকৃতি লাভের দাবিদার। তবে যুগের প্রয়োজনে উন্নতমানের আমচাষের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে এ জেলাতেই একটি Mango Research Institute প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। জাতীয় স্বার্থে এটি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
সর্বোপরি আমের গুণগত মান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কীটনাশক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাগানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেচ সীমিত করা, নতুন জাত উদ্ভাবন ও গবেষণার পরিধি বাড়ানো, ফ্রুট প্রোটেক্টিং ব্যাগের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি বাস্তবায়নে সহায়তা করার জন্য ‘জাতীয় আম নীতির’ প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। এই
 জেলায় শত শত বা হাজার বছর ধরে বিরাজমান রয়েছে ‘আম সংস্কৃতি’ এবং এসবই শিকড়ের পরিচয় বহন করে। মধ্যযুগে গৌড়ের ফজলি বিবি যে মনভোলানো আম খাইয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন- সেটি পরবর্তীকালে ‘ফজলি আম’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পরিশেষে ফজলিসহ গোপালভোগ, ল্যাংড়া, আশ্বিনা আমগুলোর জিআই পণ্যস্বত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনুকূলে নিবন্ধনের জন্য জেলা প্রশাসনসহ অত্র জেলাবাসীদের উদ্যোগ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।ফলে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই ‘ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম ’ ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পন্যের স্বীকৃতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
** অন্যদিকে রাজশাহীর ফজলি আম জি আই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করছেন রাজশাহীবাসী। তারা যুক্তি ধরে বলেন,  রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাওয়া পুরোনো কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায় ১৯১২ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত করা সার্ভে এন্ড সেটেলমেন্ট অপারেশনস ইন দি ডিস্ট্রিক অব রাজশাহীর চূড়ান্ত প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনের ১৬ নম্বর পৃষ্টায় ইংরেজীতে স্পস্টভাবে ‘দি বাঘা ম্যাংগো’ বা বাঘার আম যা কলকাতায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
শুধু তাই নয় হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর ‘আম’ বইটির অষ্টম অধ্যায়ে আমের জাত বিভাগে ৯৭ পৃষ্ঠার তথ্য অনুযায়ী বাঘার ফজলির পরিচিতি অন্তত ২০০ বছরের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ৫০০ বছর আগে নির্মিত রাজশাহীর বাঘার ঐতিহ্যাসিক শাহী মসজিদের অংশে টেরাকোটার কারুকাজেও দেখা মেলে আমের ছবি। এ থেকেও বুঝা যায় বাঘার ফজলি আমের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ফল গবেষক ড. হাবিবুল আলম বলেন, বাঘার শাহী মসজিদের কারুকাজ করা এই আম ফজলি আমের প্রতিচ্ছবি। এতেও প্রমান হয় বাঘার ফজলি আমের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। আমরা যে তথ্য প্রমান পেয়েছি ফজলি আম রাজশাহীর পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যতেষ্ঠ।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্ত কৃষিবিদ ড. আলীম উদ্দীন বলেন, শুধু খাতা-কলমেই নয়, ভৌগলিক পরিচয় নিশ্চত করতে এরই মধ্যে বাঘার ফজলি আমের ডিএনএ পরীক্ষাও করা হয়েছে। তার প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়েছে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমের যে জাতের কথা বলা হচ্ছে তার সাথে বাঘা ফজলির স্বাদ, আকার, ওজনসহ অনেক পার্থক্য রয়েছে।
তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম মূলতে ভারতে মালদহ এলাকার। ২০০৮ সালে মালদহের ফজলি আম তাদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই ‘রাজশাহীর ফজলি আম’ ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পন্যের স্বীকৃতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জনপ্রিয় সংবাদ

কাওরাইদ রেলওয়ে স্টেশনে যমুনা এক্সপ্রেসের যাত্রাবিরতির দাবিতে এলাকাবাসীর মানববন্ধন

আজ ফাইনাল

ফজলি আম নিয়ে চাঁপাই- রাজশাহীর যুদ্ধ

আপডেট সময় ০৩:২৫:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ মে ২০২২
ফজলি আম কার তা নির্ধারণ হবে আজ মঙ্গলবার। এই আমের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৃথকভাবে দাবি করেছে। যার শুনানী আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে। এর পর জানা যাবে ফজলি আম রাজশাহীর না চাঁপাইনবাবগঞ্জের।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের শুরু দিকে বাঘার ফজলি আম রাজশাহীর জিআই পন্য হিসেবে স্বীকৃতি জন্য আবেদন করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ প্রয়োজনীয় তথ্য যুক্ত করে এ আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই বাছাই শেষে সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় গত বছরের ৬ অক্টোবর বাঘার ফজলি আমকে রাজশাহীর নিজস্ব পণ্য হিসেব স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর।
তবে ফজলি আম নিজেদের অঞ্চলের দাবি করে এই সিদ্ধান্তের উপর নারাজি দেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এ্যাসোসিয়েশন। আর এতেই জিআই সনদ আটকে যায় রাজশাহীর ফজলি আমের। আগামীকাল ২৪ মে মঙ্গলবার শুনানির মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিস্পত্তি করতে চায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আখতারুল ইসলাম বলেন, ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাচীনতম ফল ফজলি আম উৎপাদন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। দেশ বিভাগের আগে এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছিল মালদা জেলার অন্তর্গত।
ফজলি আম নিয়ে আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দীর্ঘ ইতিহাস। তিনি আরো বলেন,
ফজলি আম, ভৌগলিক নিদর্শন চাঁ,নবাবগঞ্জের নাকি রাজশাহীর,সমাধান আজ। তিনি আসবাদ ব্যক্ত করেন , চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলে আম জিআই পন‌্য হিসাবে স্বীকৃতি পাবে।
তিনি ফজলি আমের পুরাতন ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন ,চাঁপাইনবাবগঞ্জ পূর্বে মালদা জেলার অংশ হিসেবে আড়াই হাজার বছরের আমচাষ ও বিপণনের ঐতিহ্য বহন করে। সে সময় থেকে বর্তমানেও বড় বড় আমবাগান, এমন কী একক ব্যক্তিমালিকানায় একশ’-দেড়শ’ বিঘার বাগান এখনো বিদ্যমান। দেশ বিভাগের আগে ও পরে মধ্য আষাঢ়ের পর বারঘরিয়া, কানসাট, রহনপুর, ভোলাহাট থেকে নদীপথে ৪০০-৫০০ মণ আমভর্তি প্রচুর নৌকা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে বাজারজাত করার জন্য ঢাকুয়ালরা (ঢাকার আম ব্যবসায়ী) ছুটে আসত। তার আগে নৌকায় কলকাতায় নেয়া হতো। বর্তমানে উন্নত সড়ক অবকাঠামোর সুবাদে বাগান বা আড়ৎ থেকে ট্রাকযোগে আম দেশের অধিকাংশ জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে। দেশের বৃহত্তম আমের বাজার বা ব্যবসা কেন্দ্র হচ্ছে কানসাট, যেখানে মৌসুমে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ আম কেনাবেচা হয়।
ফলে দেশভাগ এবং স্বাধীনতার পর এককভাবে আম উৎপাদন ও বিপণনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।
দেশভাগের পূর্ব থেকে রাজশাহী পুরোনো জেলা হলেও এই জেলায় আমচাষের প্রচলন সেভাবে ছিল না। যৎসামান্য চাষাবাদ হলেও খ্যাতি লাভ করেনি। সমসাময়িক কালে সেখানে আমের চাষাবাদ বাড়লেও ফজলি বাগান ও উৎপাদন সেভাবে বাড়েনি, সাম্প্রতিককালে সেখানে উৎপাদন সব ধরনের আমসহ কমবেশি ৪০ হাজার টন। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শত বছরেরও অধিক ফজলি আমের বাগানের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান এবং মোট উৎপাদনের প্রায় ১৭%। দেশের পূর্বাঞ্চলের অনেক জেলায় ফজলি মালদহি আম হিসেবে বয়স্কদের নিকট পরিচিত।
সুইডেন প্রবাসী ও ব্যবসায়ী বদরুদৌজা নাচোলের লোক। তিনি ২০১৩ সালে নাচোলের এক বাগান থেকে সুইডেনের মতো পশ্চিমা দেশে সর্বপ্রথম মানসম্মত উপায়ে সীমিত পরিমাণে আম রপ্তানি করেন। পরের বছর থেকে ইউরোপের বৃহত্তর বাজারে দেশ থেকে রপ্তানি শুরু হয় এবং মাঝে একাধিক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়।
২০১৭ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হঠকারী সিদ্ধান্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ অঞ্চলের আম রপ্তানি থেকে বঞ্চিত করা হয়। সে সময় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো আম রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। মেহেরপুর নিবাসী এক কোয়ারেন্টাইন কর্মকর্তা সে জেলার রপ্তানিযোগ্য আম গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হবার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ঘোষণা করে দেশে কোনো রপ্তানিযোগ্য আম নেই। ফলে সে বছরে এতদঞ্চলের ৮ কোটি আম রপ্তানি করতে ব্যর্থ হয়।
মাত্র ৩০ হাজার টন উৎপাদন সক্ষম সাতক্ষীরা জেলার ব্যবসায়ীরা স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অসাধু পন্থা যথা আঁটি পোক্ত না হওয়া সত্ত্বেও কৃত্রিম উপায়ে আমের রঙ হলুদ করে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করে। এ ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের মে মাসের মাঝামাঝির পর। এখানেও ছলনার আশ্রয় নেয়া হয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর আম হিসেবে এগুলো রপ্তানি করা হয়েছিল।
রপ্তানিকৃত সমস্ত আম ফেরত আসে এবং আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে আম রপ্তানি। এ সময় দেশের বিভিন্ন জেলায় ৮ কোটি আম রপ্তানির উদ্দেশ্যে পরিচর্যা করা হয়, এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই ছিল সাড়ে ছয় কোটি। দেশের সব ধরনের গণমাধ্যম সাতক্ষীরার আম ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট কৃষি দপ্তর কর্মকর্তাদের অপকর্মের কার্যকলাপ প্রধান শিরোনাম হয় ও সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে ওঠে।
দেশভাগ রাজশাহীর জন্য শাপে বর হয় এবং কপাল পুড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার। শিবগঞ্জ-ভোলাহাটের আম রাতারাতি রাজশাহীর আম নামে দেশে পরিচিতি লাভ করে, সে ধারা আজও আংশিক বিদ্যমান।
 উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্বীকৃতি লাভের দাবিদার। তবে যুগের প্রয়োজনে উন্নতমানের আমচাষের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে এ জেলাতেই একটি Mango Research Institute প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। জাতীয় স্বার্থে এটি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
সর্বোপরি আমের গুণগত মান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কীটনাশক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাগানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেচ সীমিত করা, নতুন জাত উদ্ভাবন ও গবেষণার পরিধি বাড়ানো, ফ্রুট প্রোটেক্টিং ব্যাগের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি বাস্তবায়নে সহায়তা করার জন্য ‘জাতীয় আম নীতির’ প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। এই
 জেলায় শত শত বা হাজার বছর ধরে বিরাজমান রয়েছে ‘আম সংস্কৃতি’ এবং এসবই শিকড়ের পরিচয় বহন করে। মধ্যযুগে গৌড়ের ফজলি বিবি যে মনভোলানো আম খাইয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন- সেটি পরবর্তীকালে ‘ফজলি আম’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পরিশেষে ফজলিসহ গোপালভোগ, ল্যাংড়া, আশ্বিনা আমগুলোর জিআই পণ্যস্বত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনুকূলে নিবন্ধনের জন্য জেলা প্রশাসনসহ অত্র জেলাবাসীদের উদ্যোগ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।ফলে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই ‘ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম ’ ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পন্যের স্বীকৃতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
** অন্যদিকে রাজশাহীর ফজলি আম জি আই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করছেন রাজশাহীবাসী। তারা যুক্তি ধরে বলেন,  রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাওয়া পুরোনো কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায় ১৯১২ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত করা সার্ভে এন্ড সেটেলমেন্ট অপারেশনস ইন দি ডিস্ট্রিক অব রাজশাহীর চূড়ান্ত প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনের ১৬ নম্বর পৃষ্টায় ইংরেজীতে স্পস্টভাবে ‘দি বাঘা ম্যাংগো’ বা বাঘার আম যা কলকাতায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
শুধু তাই নয় হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর ‘আম’ বইটির অষ্টম অধ্যায়ে আমের জাত বিভাগে ৯৭ পৃষ্ঠার তথ্য অনুযায়ী বাঘার ফজলির পরিচিতি অন্তত ২০০ বছরের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ৫০০ বছর আগে নির্মিত রাজশাহীর বাঘার ঐতিহ্যাসিক শাহী মসজিদের অংশে টেরাকোটার কারুকাজেও দেখা মেলে আমের ছবি। এ থেকেও বুঝা যায় বাঘার ফজলি আমের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ফল গবেষক ড. হাবিবুল আলম বলেন, বাঘার শাহী মসজিদের কারুকাজ করা এই আম ফজলি আমের প্রতিচ্ছবি। এতেও প্রমান হয় বাঘার ফজলি আমের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। আমরা যে তথ্য প্রমান পেয়েছি ফজলি আম রাজশাহীর পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যতেষ্ঠ।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্ত কৃষিবিদ ড. আলীম উদ্দীন বলেন, শুধু খাতা-কলমেই নয়, ভৌগলিক পরিচয় নিশ্চত করতে এরই মধ্যে বাঘার ফজলি আমের ডিএনএ পরীক্ষাও করা হয়েছে। তার প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়েছে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমের যে জাতের কথা বলা হচ্ছে তার সাথে বাঘা ফজলির স্বাদ, আকার, ওজনসহ অনেক পার্থক্য রয়েছে।
তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম মূলতে ভারতে মালদহ এলাকার। ২০০৮ সালে মালদহের ফজলি আম তাদের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই ‘রাজশাহীর ফজলি আম’ ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পন্যের স্বীকৃতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।