একদিকে ঋণের বোঝা অপরদিকে সুতার দাম। বৃদ্ধি আর শ্রমিক সংকট থাকায় ঠিকমতো শাড়ি তৈরি করতে পারছেন না তারা।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বাতাঁবো) ঋণ সহযোগিতা না করায় দেখা দিয়েছে পুঁজি সংকট। এতে করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিকরা শাড়ি উৎপাদনে যেতে পারছেন না। অনেকেই বাধ্য হয়ে ঝুঁকে পড়ছেন ভিন্ন পেশায়।
টাঙ্গাইল জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার তাঁত রয়েছে। এতে ১ লাখ ৩ হাজার ২০৬ জন তাঁত শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তবে বর্তমানে এই তাঁতের এক তৃতীয়াংশই পুঁজির অভাবে বন্ধ রয়েছে।
নেই আগের সেই চিরচেনা খটখট শব্দ। কেউ তাঁত ঘরে করেছেন দোকান ঘর। আবার কেউ ব্যবহার করছেন বিভিন্ন গোডাউন হিসেবে। অন্যকোনো কাজ না জানায় বেকার হওয়া তাঁতি ও শ্রমিকেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন। পুঁজি হারানো তাঁতিদের অনেকেই পরবর্তীতে ধারদেনা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও সুতা ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের সব প্রচেষ্টা বিফলে গিয়েছে।
টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শাড়ির পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। একসময় বাংলাদেশের খ্যাতি ও গৌরব ছিল মসলিন এবং জামদানির জন্য। এর মধ্যে জামদানি টিকে থাকলেও মসলিন ইতিহাসের পাতায়। তবে মসলিন ও জামদানির পর দেশীয় বস্ত্র খাতে টাঙ্গাইল শাড়ি নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা, বুনন ও রঙের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র রয়েছে। সাধ্যের মধ্যে দাম আর বাহারি কারুকাজ খচিত হওয়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি সব সময় নারীদের পছন্দের শীর্ষে। ফলে টাঙ্গাইল শাড়ি দেশের সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা এবং জাপানেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, তাঁতশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখা এ শিল্পের মূল সমস্যা পুঁজি বা মূলধন ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি। গত দুই ঈদে করোনার কারনে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ে এবার পুরো তাঁতপল্লী এখন থমকে আছে। ঈদ উপলক্ষে তাঁতপল্লীগুলোতে নেই শাড়ি তৈরির ধুম। দীর্ঘ লকডাউনের কারনে শাড়ি উৎপাদন বন্ধ থাকায় এ পেশায় জড়িত অনেক শ্রমিক অনত্র ভিন্ন পেশায় চলে গেছে। একদিকে ঋণের বোঝা, সুতার মূল্যবৃদ্ধি আরেকদিকে শ্রমিক সংকট থাকায় অধিকাংশ মালিক তাঁত বন্ধ করে দিয়েছেন।
কয়েকজন তাঁতি জানান, দীর্ঘসময় ধরে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প মহাসংকটে রয়েছে। একদিকে কাচাঁমালের দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি না হওয়ায় পুঁজি ভেঙে খরচ করতে করতে পুঁজিশূন্য হয়ে পড়েছে বেশিরভাগ তাঁতি ও মহাজন। ফলে বাধ্য হয়ে তারা একের পর এক তাঁত বন্ধ করে দিচ্ছেন। এর মধ্যে কিছু তাঁতী ব্যাংক থেকে ঋণ ও ধারদেনা করে পুনরায় তাঁত সচল করলেও উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি করতে না পেরে দিনের পর দিন ঋণের জালে জর্জরিত হচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রুত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই শিল্প আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আর এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে না পারলে মালিকদের পাশাপাশি লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। অন্যদিকে অর্থনিতীতে বিরুপ প্রভাব পরবে বলেও মনে করছেন তারা।
সম্প্রতি মহামারি করোনার ছোবলে নিঃস্ব হতে হয়েছে মাসুদ নামের এক ব্যক্তিকে। প্রায় ২০ লাখ টাকার উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি করতে পারেননি। দু’বছর ধরে ধারদেনা করে সংসার চলছে তার। স্বপ্ন দেখছিলেন হয়তো সুদিন আবারও ফিরে আসবে। কিন্তু নতুন মূলধনের অভাবে নতুন করে আজও শাড়ি উৎপাদনে ফিরতে পারেনি। অন্যদিকে সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে ধার-দেনা করে শাড়ি তৈরি করার সাহস পাচ্ছে না। এদিকে দীর্ঘদিন মেশিনগুলো বন্ধ থাকায় লাখ লাখ টাকার মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঈদ যতোই ঘনিয়ে আসছে দুশ্চিন্তা যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটছে তার। মাসুদ রানার মতো এমন হাজারও তাঁত মালিক করোনায় নিঃস্ব হয়ে পুঁজির অভাবে তাঁত বন্ধ করে রেখেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা।
এ অবস্থায় তাঁতগুলো চালু করতে স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তাসহ সরকারি সহযোগিতার দাবি তাদের।