![](https://www.nababani.com/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
পদ্মা নদীর তল থেকে ৪২০ ফুট গভীর কূপে নামতেন যাঁরা, সেই নির্মাণ শ্রমিকদের কথা কি আমাদের জানা আছে?
পদ্মা সেতুর ৪২টা পিলারের নিচে আছে পাইল। সেই পাইল বসানোর জন্য প্রতিটি পিলারের স্থানে প্রথমে ৬টা করে স্টিলের বেড় দেওয়া কূপ বসানো হয়, ১০ ফুট ব্যাসের কূপ। তারপর সেই কূপের ভেতরে মাটি-পানি অপসারণ করা হয় পাম্প করে। তখন ৪২০ ফুট গভীর সেই অন্ধকার কূপের মধ্যে নামতে হতো বাংলার নির্মাণবীরদের।
২০১৭ সালের পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে কিছু উদ্ধৃতি পড়লে হয়তো আপনার চোখও অজান্তেই ভিজে উঠবে, “অন্ধকার পাইলের মধ্যে নামতে ভয় করে না?” এমন প্রশ্ন শুনে অনেকটা অবাক হলেন নির্মাণ শ্রমিক তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “ভয় কিসের! কাজ করতে এসে ভয় কিসের! অন্যরা যেমন কাজ করে, আমরাও তেমনই কাজ করি।” এর সঙ্গে যুক্ত করেন, “ভয় করে না, কারণ পাইলের মুখের চারপাশ ঘিরে রাখা হয়। তবে পাইলের মধ্যে নামলে ভীষণ গরম লাগে। এত গরম যে বলার মতো না। ঘামে শরীর ভিজে যায়। তাই পাতলা কাপড় পরে নামতে হয়।”
পাইলে নামার সময় সব ধরনের নিরাপত্তাই থাকে বলে জানান রাজু নামে আরেক শ্রমিক। তিনি বলেন, পাইলের নিচের জায়গা বেশ ফাঁকা। তবে গরমে বেশি সময় পাইলের মধ্যে থাকা যায় না। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই পাইলের ভেতর গরম লাগে।
তাজুল, জাকির, মোস্তফার মতো তিন হাজার শ্রমিকের বিন্দু বিন্দু ঘামে গড়ে উঠছে পদ্মা সেতু। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে ছাড়তে হবে পদ্মার পাড়। তবু কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ, পদ্মা সেতু দেখিয়ে দিচ্ছে বড় পথ। যেখানে বুক ফুলিয়ে আরও গভীরে নামতে হবে তাঁদের।’
২৫ জুন ২০২২ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনও হয়ে গেছে। গৌরব আর আত্মমর্যাদার প্রতীক এই পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদের টাকায়ই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, জনগণের উপার্জিত টাকায় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছে! ‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’—বঙ্গবন্ধুর এই কথা তো আমাদের আবারও উদ্বুদ্ধ করবেই।
২২ জুন ২০২২ সংবাদ সম্মেলনে বারবার করে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করছিলেন বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের অবদানের কথা, বিশেষজ্ঞদের কথা। স্মরণ করছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের কথা। প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, জামিলুর রেজা চৌধুরী দেখে যেতে পারলেন না! গত ২৮ এপ্রিল ২০২০ আমরা তাঁকে হারিয়েছি। বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাখ্যানের পর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু করেছি; ইঞ্জিনিয়ারিং দিকটা বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সুষ্ঠুভাবে সামলাতে পারবে; আপনারা অর্থের দিকটা দেখুন।’ যমুনা সেতুতে জামিলুর রেজা চৌধুরী, আইনুন নিশাত, ফিরোজ আহমেদ স্যার যুক্ত ছিলেন।
পদ্মা সেতু রাজনৈতিক মর্যাদা, স্বনির্ভরতা, সাহস, দৃঢ়তা, সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক; তা যেমন আমরা বারবার বলব, তার পাশাপাশি যেন আমরা গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করি, এই পদ্মা সেতু নির্মাণ সারা পৃথিবীর সামনেই একটা ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান্ডার’, প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আদর্শ উদাহরণ।
পদ্মা প্রমত্ত নদী, আমাজনের পরেই পৃথিবীতে এটা হলো সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। এই যে ৪২টা পিলার সমুদয় ওজন বহন করবে, পিলারগুলো থাকবে কিসের ওপর? স্রোত পদ্মার তলদেশে ১৬০ ফুট পর্যন্ত মাটি ক্ষয়ে নিয়ে যায়। ১৬ তলা ভবনের সমান গভীর বললে কথাটা খানিক বোঝা যাবে। ভূমিকম্প হলে আরও ৪২ ফুট গভীরের মাটি তরল হয়ে চাপ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। সে কারণেই ৪২ তলা গভীর করে পাইল বসানো হয়েছে। গুচ্ছ পাইল। তারপরও দেখা দিল সমস্যা। ৪২টা পিলারের নিচের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেল, অনেকগুলোর নিচে মাটির শক্ত স্তর নেই। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নদীর অনেক গভীরের স্তর শক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ছয়টার জায়গায় সাতটা পাইল বসানো হয়েছে ২২টা পিলারের নিচে। এই পাইল বসানোর জন্য একাধিক হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে। এর একটা হ্যামার হলো মেঙ্ক ৩৫০০ কেজে, জার্মান কোম্পানি মেঙ্কের তৈরি, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার।’
ইস্পাতের ওপরের কাঠামো আর পিলারের মাঝখানে বিয়ারিং বসানো হয়েছে। এটা অনেক বড় ভূমিকম্প থেকে এই সেতুকে রক্ষা করবে। বিয়ারিং বসাতে গিয়েও একটা সমস্যা দেখা দিল। এই বিয়ারিং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিয়ারিং, স্থাপন করা সহজ নয়। চীনের উহানে তৈরি এই বিয়ারিং পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, এর ক্ষমতা একেবারে নিখুঁত মানসম্পন্ন আছে কি না। কিন্তু পদ্মা সেতুতে বসাতে গিয়ে একটা বিয়ারিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন প্যানেল কোয়ালিটিতে একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্যানডিয়েগোর শ্রেষ্ঠতম ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে কোয়ালিটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল ওই বিয়ারিং বসানো হয়েছে।
সব মিলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। সান ফ্রান্সিসকোর বে ব্রিজের খরচ ১৯৯৯ সালে ধরা হয়েছিল ১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শেষে এর খরচ দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইন, ভূমিকম্পসহনঈয় করা, বিয়ারিং জটিলতা আর ১৬ বছরের মুদ্রাস্ফীতি মিলিয়ে আনুমানিক ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় খুবই যৌক্তিক।
তাই আরও একবার আমাদের প্রকৌশলী, নির্মাণ কারিগর, বিশেষজ্ঞ, কর্তা, শ্রমিকসহ দেশ-বিদেশের প্রকৌশল এবং ব্যবস্থাপনা-কর্মীদের স্যালুট জানাই। আর প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটাই আবার বলি, এই সেতুর গৌরব বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের। দেশের মানুষকে সালাম। অন্ধকার খনির ভেতর নামা সেই তাজুলেরা এখন কোথায় আছেন জানতে ফোন করেছিলাম পদ্মা সেতুর একজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে। তিনি বললেন, কাজ শেষে নির্মাণশ্রমিকেরা কোথায় গেছেন, তা আমরা জানি না। তবে বেশির ভাগই বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন।
তাজুল ভাইয়েরা, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।